১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৯:২৩

অধরাই থাকলো তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি

চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আড়াই বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা আছে। আমরা এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যের চেষ্টা চালাচ্ছি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সবাই ধারণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পিত দিল্লি সফরের সময়ই তিস্তা চুক্তি সই হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবারো অধরাই হয়ে থাকলো তিস্তা চুক্তির বিষয়টি। এটি এখন শুধু অধরাই নয়, তিস্তা চুক্তি যে অনিশ্চিৎ সেটা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, তিস্তার পানিতে তো তার দেশেরই চলে না। এছাড়া তিস্তায় নাকি পানিও নেই। তার পরিষ্কার কথা, আইনে কি আছে সেটি বুঝার দরকার নেই। তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেয়া যাবেনা। এছাড়া অভিন্ন ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা নিয়েও তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বাংলাদেশে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সর্বমহলের জোরালো দাবির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, তার সরকারের আমলেই নাকি এই চুক্তি হবে। তিনি তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশাবাদী। তবে সুনির্দিষ্ট করে মোদি কিছুই বলেন নি।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান ভারত সফরে যে তিস্তা চুক্তি হবেনা সেটি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। তারা এ নিয়ে কোনো ধরনের দেন-দরবারও করেননি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের তেমন কোনো মূল্যই থাকলো না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তিই ছিল জনগণের প্রধান দাবি। কাজেই তিস্তার পানি ছাড়া অন্য কোনো চুক্তি জনগণ মানবে না বলে তারা মনে করেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো চুক্তি নানা কারণে স্পর্শকাতর। কাজেই যে কোনো বিষয়ে চুক্তি হলেও সে সম্পর্কে জনগণ বিস্তারিত জানতে চায়। জনগণকে না জানিয়ে যখন অন্ধকারে রাখা হয়, তখনই নানা ধরনের সন্দেহ-গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো সেগুলো সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। এমনকি সংসদেও এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ কোনো দেশের সাথে চুক্তি করার আগে সংসদে আলোচনা করার বিধান রয়েছে। ফলে ভারতের সাথে অনুষ্ঠিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে এখনো দেশের মানুষ অন্ধকারে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ভারতের স্বার্থের চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তা ও অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনসহ বাংলাদেশের কোনো চাওয়াই চুক্তি ও স্মারকে স্থান পায়নি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, তিস্তা বাদ ভারতের সাথে যে সব চুক্তি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হয়নি। এই সফরে যা কিছু অর্জন তার সবই পেল ভারত। তিনি বলেন, পানি হচ্ছে দেশের জীবন-মরণ সমস্যা। অথচ সরকার তিস্তা চুক্তি বাদ দিয়ে প্রতিরক্ষাসহ অনেকগুলো চুক্তি করেছে।
বিশিষ্টজনরা বলেছেন, ভারতের সাথে প্রতিরক্ষাসহ যে ৩৬ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো তাতে ভারতই বেশী সুবিধা পেল। তারা বাংলাদেশের মানুষের বড় আশার তিস্তা চুক্তি ‘জিইয়ে’ রেখে বাংলাদেশ থেকে বড় ধরণের সুবিধা নিতে চায়। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তা চুক্তি হলো না। আশা জিইয়ে রাখা হলো। এর ফলে ভারত সম্পর্কে জনগণের আগের ধারণার পরিবর্তন হবে না। তবে যেসব চুক্তি হয়েছে তা গতানুগতিক। তাতে নতুনত্ব নেই। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণ সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে বাংলাদেশকে। এটা দেওয়া হচ্ছে তৃতীয়বারের মতো। এখানে আগের ঋণের টাকা বাংলাদেশ খরচ করতে পেরেছে কি না সেটা দেখা দরকার ছিল। এখানে জনগণের উন্নয়ন জড়িত সত্য, তবে তা আগের চুক্তির ধারাবাহিকতায় হয়েছে। একেবারে নতুন কিছু হয়নি, যাতে মানুষ সাংঘাতিক খুশি হতে পারে। আসলে দিল্লির নীতিনির্ধারকরা আগের মানসিকতায় আছেন। দীর্ঘসূত্রতায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বৃত্ত থেকে তারা বের হতে পারেন না। দীর্ঘসূত্রতায় মানুষের উৎসাহ নষ্ট হয়ে যায়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে উভয় দেশের সম্পর্ক গভীর হয়েছিল। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার জন্য যে ঘোষণা এসেছে তাতে করে ভারত প্রতিরক্ষা কৌশলে এগিয়ে থাকতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। ভারত কী কী অস্ত্র বা সরঞ্জাম বিক্রি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে এ ক্ষেত্রে তা বড় বিবেচ্য নয়। কোনো কোনো দেশে তারা রাইফেল বিক্রি করছে। আফ্রিকার দেশগুলোয়, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে তারা বাজার তৈরি করছে। তারা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঋণ দিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা করছে বাংলাদেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের দোহাই দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। অথচ ভারত অনেক দ্বিপাক্ষিক বিষয় এগিয়ে নিচ্ছে যাতে অন্য কোনো রাজ্যকে প্রকাশ্যে টেনে আনছে না। তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম। উজানের দেশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে চাচ্ছে না। এজন্য তারা কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের নাম ব্যবহার করছে। দেশটিতে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই শুধু বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাবে। এর আগে সম্ভাবনা খুবই কম। তিস্তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সরকারের এক উত্তর, তা হল ভারত বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে চুক্তি হবে। সে অনুযায়ী একটি খসড়াও প্রস্তুত।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, প্রতিরক্ষা নয়, আমরা চেয়েছিলাম তিস্তা চুক্তি। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের জনগণের স্বার্থে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ দু’দেশের মধ্যে জিইয়ে থাকা বিরোধগুলোর সমাধান অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ ছিল। তিস্তাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যু বাদ দিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ অনেক চুক্তি হয়েছে। তার কারণে জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম হতে পারে। বছরের পর বছর ধরে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতে পানি সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটি বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। ভারতের সঙ্গে যে কোনো চুক্তির চেয়ে তিস্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এটি অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই সফরেও সেটি হলো না।
জানা গেছে, ২০১০ সালে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদী একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ওই চুক্তির খসড়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়- তিস্তার ৪০ ভাগ পানি ভারত পাবে এবং ৪০ ভাগ পাবে বাংলাদেশ। আর তিস্তার নাব্য রক্ষার জন্য থাকবে বাকি ২০ ভাগ পানি। বাংলাদেশের এ প্রস্তাব নিয়ে মমতা ব্যানার্জির তীব্র আপত্তি থাকায় ঝুলে যায় বাংলাদেশ-ভারত অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি। সর্বশেষ গত ১৬ বছরে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় বাংলাদেশ অংশে কি পরিমাণ পানি ছিল তার তথ্য-উপাত্ত চায় পশ্চিমবঙ্গ। এ পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ নদী কমিশন থেকেও পশ্চিমবঙ্গের কাছে জানতে চাওয়া হয়, জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধের সামনে গত ১৬ বছরে কী পরিমাণ পানি ছিল। একই সঙ্গে গজলডোবা বাঁধের ২৫ কিলোমিটার উজানে ডাইভার্সন পয়েন্ট থেকে পানি ভাগাভাগি হবে নাকি ডাইভার্সন পয়েন্টের ভাটিতে জমা পানি ভাগাভাগি হবে তাও জানতে চাওয়া হয়। ভারত থেকে তিস্তা বাংলাদেশের যে প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে সেই নীলফামারীর ডোমার উপজেলার কালিগঞ্জ গ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখতে কি পরিমাণ পানি ছাড়া হবে- এটাও নির্দিষ্ট করতে বলা হয় পশ্চিমবঙ্গকে। বিষয়টি সেখানেই ঝুলে রয়েছে।
যৌথ নদী কমিশনের (বাংলাদেশ) উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডালিয়া পয়েন্টে যে পানি পাওয়া গেছে, তা ১৯৭৩-৮৫ সময়কালের গড় পানিপ্রবাহের চেয়ে অনেক কম। ডালিয়া পয়েন্টে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন ও শেষ ১০ দিনে পানির গড় প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৭০১০, ৬০১০ ও ৫৬৬৮ কিউসেক। আর এ বছরের জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন ও শেষ ১০ দিনে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ২৩৮৪, ১৭৬০ ও ১১৯০ কিউসেক। পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানির প্রবাহ বেশ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাব উল্লেখ করা হয়। ৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মধ্যে ভারতে প্রবাহিত ২৪৯ কিলোমিটার ও বাংলাদেশে ১১৭ কিলোমিটার। তিস্তার আওতায় মোট সেচ এলাকার পরিমাণ ১৯ দশমিক ৬৩ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৪৯ লাখ হেক্টর ও ভারতে ১২ দশমিক ১৪ লাখ হেক্টর। নীলফামারী জেলার বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে প্রতিদিন ন্যূনতম ৩৫০০ কিউসেক পানির প্রয়োজন হয়।

 

http://www.dailysangram.com/post/279220-