১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৯:২১

খুলনার শিবসা নদী নাব্য হারিয়ে এখন মরা খাল

খুলনার পাইকগাছায় এক সময়ের প্রমত্তা শিবসা নদী নাব্য হারিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে নদীটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যার কারণে ভাটার সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে নৌযান চলাচল। আর এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। নদীটি দ্রুত খনন না করলে কূল উপচে দুই এক বছরের মধ্যে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
দক্ষিণের নদ-নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম শিবসা। কপোতাক্ষের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে শিবসা; যা সুন্দরবন পেরিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। পাইকগাছার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্য নদ-নদীগুলোর সংযোগ রয়েছে শিবসার সঙ্গে। যার কারণে এই জনপদের পানি প্রবাহের প্রধান মাধ্যম শিবসা। তিন দশক আগেও নদীটির ছিল ভরা যৌবন। এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে যখন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি তখন যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল শিবসা নদী। জেলা শহরে যাতায়াতসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব পণ্য আনা-নেয়ার অন্যতম মাধ্যমও ছিল এ নদী। জেলে সম্প্রদায়সহ নিম্ন আয়ের শত শত পরিবার নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো।
কিন্তু কালের বিবর্তনে নদীটি হারিয়ে যেতে বসেছে। পলি জমতে জমতে শিববাটী থেকে সোলাদানার ত্রিমোহনী পর্যন্ত নদীর প্রায় ১৫ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। জোয়ারের সময় প্রাণবন্ত মনে হলেও ভাটার সময় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নদীটি। যার কারণে জোয়ারের সময় যাত্রীরা নৌকায় পার হতে পারলেও ভাটার সময় হাঁটু কাদা ভেঙে পায়ে হেঁটে নদী পার হতে হয়। যেভাবে নদী ভরাট হচ্ছে তাতে অল্পদিনের মধ্যেই নদীটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এর ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে বলে আশংকা করছেন এলাকাবাসী।
ব্যবসায়ীরা জানান, এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব পণ্য এক সময় নদী পথে সরবরাহ করা হতো। শিবসা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছর নৌপথে পণ্য আনা-নেয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। কারণ, নৌপথে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে খরচ ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়।
খুলনা জেলা পরিষদ সদস্য শেখ কামরুল হাসান টিপু জানান, নদীটি ইতোমধ্যে জোয়ারের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যার কারণে জোয়ারের উপচেপড়া পানি জনপদে ঢুকে উপজেলা সদর প্লাবিত করছে। দ্রুত খনন না করলে অল্পদিনেই উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলবে বলে এই জনপ্রতিনিধির আশঙ্কা। নদীটি দ্রুত খনন করার দাবি এলাকাবাসীর।
এদিকে শুধুমাত্র শিবসা নয় পদ্মার এপারের অধিকাংশ নদ-নদীই শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রায় অর্ধশত নদীতে বালু জমে বড় বড় চর পড়েছে। এ সকল নদী দিয়ে নৌযান চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শুকনা মওসুমে নদীতে পানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় সংযোগ খালগুলোতে একেবারেই পানি নেই। সেচ ব্যবস্থা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সেচ নির্ভর ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দিন দিন কমে আসছে।
নদী গবেষকদের মতে, বিভিন্ন নদী অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া, বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ আটকে দেয়া, উজান থেকে পানির প্রবাহ না আসা এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। মরে গেছে আরো চারটি নদী। শুকিয়ে যাচ্ছে একটির পর একটি নদী ও শাখা নদী।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীগুলোর সাথে তাদের প্রাণভোমরা মূল নদীর সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- নদীকে গলাটিপে মারছে। নদী মরে যাওয়ার কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। চলতি শুষ্ক মওসুমে পানি সংকট দেখা দিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। শুষ্ক মওসুমেই যেন নদীর মড়ক লাগে। আর এই মরা নদীর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এক একটি ইতিহাস। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক স্মৃতি সাহিত্য-ঐতিহ্য, লোক কাহিনী ও জীবনের গল্প।
খুলনা বিভাগ থেকে যে পাঁচটি নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে তা হলো-খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা এবং যশোরের মুক্তেস্বরী ও হরিহর নদী। আর মৃতপ্রায় যে চারটি নদী তা হলো, খুলনার আঠারোবাকী, যশোরের ভদ্রা, নড়াইলের নবগঙ্গা ও ঝিনাইদহের চিত্রা নদী। খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদী। প্রাচীনতম এই ভৈরব নদীর সঙ্গে বঙ্গীয় অঞ্চলের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এক কালের প্রমত্তা ভৈরব এখন স্রোতহীন। এই ভৈরবকে ঘিরে এ অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। নদী পাল্টে যাওয়ার সাথে সাথে পাল্টে গেছে জনবসতী। ভৈরব এখন ঐ অঞ্চলের দুঃখ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর স্রোত বহু আগেই কমে গেছে। মধুমতি নদীতে চর পড়ে ভরাট হওয়ার কারণে খুলনা-ঢাকা-ভায়া মাদারীপুর লঞ্চ সার্ভিস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। খুলনা-বটদিয়া-পাটগাতি-হুলারহাট-বরিশাল রুট বহু আগে বন্ধ হয়েছে। খুলনা-গোপালগঞ্জ ভায়া মানিকদাহ এখন আর লঞ্চ চলে না। খুলনা-ঘাগর ভায়া-মোল্লারহাট লাইনে আর কোন দিন লঞ্চ চলবে না। নবগঙ্গা নদী ভরাট হওয়ায় খুলনা-লোহাগড়া লাইনে লঞ্চ চলাচল বহু আগে বন্ধ হয়েছে। খুলনা-আশাশুনি রুটের অবস্থা একই। গোপালগঞ্জ হতে হুলারহাট পর্যন্ত নদীতে চর পড়ায় খুলনা-ঢাকা ভায়া-গোপালপুর বরিশাল রুটেও লঞ্চ চলাচল এখন বন্ধ। তাছাড়া পদ্মার এপারের বহু নদীর মধ্যে এখন চাষাবাদ চলছে।
এদিকে দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের স্থানে স্থানে পলি জমে স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধান নদনদীগুলো প্রতি বছর চ্যানেল পরিবর্তন করছে। এতে একদিকে যেমন ভাঙ্গন সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে পলির স্তর জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাখা উপশাখা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র পানি সংকট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে-শুষ্ক মওসুমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১৯টি নদীর পানি শুকিয়ে যায়। বর্ষা মওসুমের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।

http://www.dailysangram.com/post/279279-