নেত্রকোনা হাওরপাড়ে ফসলহারা কৃষকদের কান্না : নয়া দিগন্ত
১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৯:১৮

বান আর চোখের পানিতে একাকার হাওরাঞ্চল

প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফসল হারানো কৃষকের আহাজারিতে হাওরাঞ্চলের আকাশ-বাতাস এখন ভারী হয়ে উঠেছে। স্বজন হারানোর বেদনার মতো ব্যথাতুর হয়ে পড়েছেন তারা। এক সপ্তাহ ধরে উজান থেকে ঢলের পানি নেমে আসা অব্যাহত থাকায় আরো নতুন নতুন হাওর প্লাবিত হয়ে পড়ায় এবং পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় গোলায় ক্ষেতের সোনালি ফসল তোলার আশা এখন ছেড়ে দিয়েছেন। বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে হাওর পাড়ে ফসলহারা কৃষকদের কান্না কিছুতেই থামছে না।
নেত্রকোনায় ছোটবড় মিলিয়ে ১৪০টি হাওর রয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে এক লাখ ৮০ হাজার ১০২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়। প্রথম দিকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক লাখ ৮৪ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। তবে ফসল কাটার আগ মুহূর্তে আগাম প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মোহনগঞ্জের চরহাইজদা, ডিঙ্গাপোতা ও খালিয়াজুরীর কীর্তনখলা দীর্ঘ এই তিনটি বাঁধ ভেঙে একেক করে ফসলভরা হাওর তলিয়ে যেতে থাকে। শত শত কৃষক-কিষাণী কোদাল ও ঢাকি নিয়ে মাটি দিয়ে বাঁধ রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টার পরেও শেষ রক্ষা আর হয়নি। কৃষকদের চোখের সামনে তলিয়ে যেতে থাকে সোনালি ফসল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ খবরে জানা যায়, এক সপ্তাহে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ বোরো ফসল এখন পানিতে তলিয়ে গেছে। যার পরিমাণ অন্তত এক লাখ ৩০ থেকে ৪০ হাজার হেক্টরের মতো। টাকার অঙ্কে বিশাল এ ক্ষতির পরিমাণ এই মুহূর্তে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আর এ ক্ষতি সাধারণ কৃষকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ কৃষক প্রতিবারের মতো সুদে ঋণ নিয়ে ফসল ফলিয়ে থাকেন। গোলায় ফসল তোলার আগেই তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু চলতি মওসুমে ক্ষতির পরিমাণ অত্যধিক হওয়ায় কৃষকেরা এখন বিচলিত হয়ে পড়েছেন। বাঁধ ভেঙে এ দুর্দশার জন্য সাধারণ কৃষক ইতঃপূর্বে নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শশী মোহন সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিকে দায়ী করছেন। তার কারণেই ঠিকাদারেরা ইচ্ছামাফিক ফাঁকি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে অভিযোগ করেন।
চলতি মওসুমে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে পড়ায় অকালে আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে কাইলখালী, এক পাটিয়া, ডোবাইল, মরাখইলা, চন্দ্র সোনার খাল, কীর্তনখলা, শালদীঘা, জগন্নাথপুর, মেন্দিপুর, কৃষ্টপুর, শয়তানখালী, গোবিন্দ্রশ্রী, খয়ার হাওর, মাঘান হাওর, জয়বাংলা ও কদমশ্রীসহ শতাধিক হাওর ফসলসহ তলিয়ে যায়। অসময়ে আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ ফসলের হাওর তলিয়ে নষ্ট হয়ে পড়ায় গোটা হাওরাঞ্চলের দৃশ্যপট একেবারে পাল্টে গেছে ঘরে ঘরে এখন আর্তনাদ শুরু হয়েছে। বহু কৃষক, এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করে ফসল কাটার আগেই তাদের স্বপ্ন স্বাদ ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এক দিকে ঋণ পরিশোধের চিন্তা, অন্য দিকে ফসল বিক্রির টাকায় নিজেদের খোরাক ও ছেলেমেয়েদের বিয়ে সাদিসহ যাবতীয় সামাজিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজনের প্রাক্কালে কৃষকদের সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
মোহনগঞ্জের গাগলাজুর হাওর এলাকার তিগ্রস্ত কৃষক রমজান আলী অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, ‘আমার সব শ্যাষ হইয়া গেছে, কত আশা কইরা রাখছিলাম ফসল তুইল্যা এইবার মাইয়াডারে সাদি দিয়াম। কিন্তু পুড়া কপাইল্যা আমি; বানের পানিতে সব ভাসাইয়া লইয়্যা গেছে। আমি এখন কি করতাম আল্লারে ...।’ এ বলে রমজান আলী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেন।
জৈনপুর গ্রামের জরিনা বেগম বুক চাপড়ে চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘এহন আমি কি করতাম, পোলা-মাইয়্যারে লইয়্যা কী খাইয়াম, কার কাছে যাইয়াম।’ এই বলে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
রমজান আলী আর জরিনা বেগমের মতো এমন হাজারো কৃষাণ-কিষাণীর আর্তনাদে হাওরাঞ্চলের বাতাস এখন ভারী হয়ে উঠেছে। হাওরাঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও তাদের সাহায্য সহানুভূতি বা সমবেদনা জানাতে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা নির্বাচিত কোনো এমপি এখনো আসেননি। ফলে সেখানকার অভুক্ত কৃষকেরা রাগে দুঃখে ও ঘৃণায় এখন বিুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
গত শুক্রবার নেত্রকোনায় আয়োজিত এক মানববন্ধনে হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানানো হয়।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের এনডিসি প্রণয় কুমার চাকমা নয়া দিগন্তকে বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্গত এলাকার কৃষকদের মধ্যে গত দুই দিনে ১৫১ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আরো ১২৬ টন চাল বিতরণের জন্য মজুদ রাখা হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/211028