১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৯:১২

বিমানের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে

৮ বিভাগের মধ্যে ৭টিতেই পরিচালক নেই * সব বড় সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে * সিইও এবং পরিচালক ফাইন্যান্সের চুক্তির মেয়াদও শেষ হচ্ছে শিগগিরই

বাংলাদেশ বিমানের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটির ৮টি বিভাগের মধ্যে ৭টিতেই পরিচালকের পদ খালি। জেনারেল ম্যানেজারদের ভারপ্রাপ্ত করে চালানো হচ্ছে কয়েকটি বিভাগ। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সিইও) এবং পরিচালক ফাইন্যান্সের পদ শূন্য হচ্ছে যথাক্রমে আগামী মে ও জুলাইয়ে। নানা ব্যর্থতায় এই দুই পদে চুক্তির মেয়াদ বাড়ছে না। এ ছাড়া গত বছর মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের কর্মকর্তা পর্যায়ে ২ শতাধিক দক্ষ জনবল নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও মানবসম্পদ শাখার ডিজিএম শফিউল বারীর স্বেচ্ছাচারিতায় এখনও নিয়োগ হয়নি। কেবিন-ক্রু পর্যায়ে ২৫০ জনবল শূন্য আছে।
বিমানে মোট ৮টি বিভাগের মধ্যে একমাত্র পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ছাড়া ৭টি বিভাগে পরিচালক নেই। পরিচালক ফাইন্যান্সের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুলাইয়ে। এ ছাড়া পরিচালক প্রশাসন, পরিচালক মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস, পরিচালক কাস্টমার সার্ভিস, পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট, পরিচালক প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজেস্টিক সাপোর্ট, পরিচালক পরিকল্পনা পদগুলো শূন্য আছে। ফলে অধিকাংশ বড় সিদ্ধান্তই ঝুলে আছে। এর মধ্যে দুই মাস আগে বিমানের পরিচালক প্রকৌশল উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামানের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের অদূরদর্শিতায় এ পদে এখনও নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমানের সাবেক এমডি এয়ার কমোডর (অব.) জাকিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, একটি আন্তর্জাতিক মানের এয়ারলাইন্সের ৭টি বিভাগ পরিচালকশূন্য থাকা সত্যিই ভয়ঙ্কর। তিনি বলেন, এয়ারলাইন্স ব্যবসায় মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু পরিচালক না থাকলে সিদ্ধান্ত কে দেবে?
জানা গেছে, বিমানের পরিচালনা পর্যদের একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিচালক পদে বাহির থেকে সরাসরি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ লোক নিয়োগ দেয়ার। অপর পক্ষ বিমানের জেনারেল ম্যানেজার থেকে দক্ষ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক করার পক্ষে। এ নিয়ে চলছে রশি টানাটানি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোসাদ্দিক আহম্মেদের কথা বিমানে কেউ শোনে না। বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতাও তার নেই। তিনি সিবিএ’র কথায় চলেন। তার শাসনামলে গত এক বছরে ছোটখাটো রুটিন কাজ ছাড়া কোনো বড় সিদ্ধান্ত হয়নি। গত ৬ মাসে বিমানে ঢালাওভাবে নিয়োগ আর পদোন্নতি নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। দুদক ইতিমধ্যে এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। বেশ ক’জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তারা পদোন্নতি পেয়েছেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিমানের সব বিভাগকে জরুরি সেবার আওতায় এনে বিমানকে অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিস ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সিবিএ নেতাকর্মী এ সিদ্ধান্ত মানছে না। অভিযোগ, শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো না থাকায় এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না কোনো বিভাগ।
এদিকে শক্তিশালী প্রশাসন ও দক্ষ সিইও না থাকায় মিসর থেকে লিজে আনা একটি উড়োজাহাজ নিয়ে কেলেঙ্কারির সৃষ্টি হয়েছে। বিমানকে প্রতি মাসে উড়োজাহাজ না চালিয়েও ৫ কোটি টাকার বেশি গুনতে হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ইতিমধ্যে এই লিজ নিয়ে তদন্তে নেমেছে। অভিযোগ আছে- এই উড়োজাহাজ ভাড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিমানের সাবেক পরিচালক পরিকল্পনা বেলায়েত হোসেন, পরিচালক প্রকৌশল উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন শামীম নজরুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি ম্যানেজমেন্ট।
মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজটি বিমানের বহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে। কিন্তু পরিকল্পনা ও প্রকৌশল বিভাগের অদূরদর্শিতায় এক বছর ফ্লাইট পরিচালনার পরই উড়োজাহাজটির সব গোপন তথ্য বেরিয়ে আসে। সেই থেকে বসে আছে উড়োজাহাজটি। অভিযোগ আছে, বেলায়েত হোসেন, আসাদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল, ইজিপ্ট এয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাসান ও ইজিপ্ট এয়ারের স্থানীয় এজেন্ট মাহবুবের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট লিজ চুক্তিতে এমন কিছু শর্ত দিয়েছিল যার কারণে উড়োজাহাজটি চলুক বা না চলুক ৪ বছরের আগে সেটি ফেরত দিতে পারবে না। আর উড়োজাহাজ বসে থাকলেও প্রতি মাসে বিমানকে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ডলার (৪ কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার টাকা) আর একটি ইঞ্জিনের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার ভাড়া দিতে হবে। ফলে চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরও ২৭ মাস বসিয়ে রাখতে হবে উড়োজাহাজটি। এতে মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা হিসাবে মেয়াদ শেষে ১৩৫ কোটি টাকা দিতে হবে ইজিপ্ট এয়ারকে। আর ইঞ্জিনের ভাড়াসহ এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোসাদ্দিক আহম্মেদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই লিজ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঝামেলা দেখা দেয় ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার পর। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি ইঞ্জিন ভাড়া নেয়া হয়েছিল। তবে সে ইঞ্জিনও ঘন ঘন নষ্ট হতে শুরু করলে কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজটিকে গ্রাউন্ডেড করার সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তি অনুযায়ী, এটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিমানের কাছে রাখতে হচ্ছে। তবে আগেই ফেরত দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে।
অপরদিকে, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগে নিয়মিত পরিচালক না থাকায় বাংলাদেশসহ বিমানের ১৬টি আন্তর্জাতিক স্টেশনে টিকিট বিক্রিতে ভয়াবহ ধস নেমেছে। দেখা গেছে, ৩১৯ আসনের ফ্লাইটে গড়ে ১৫০ জনের বেশি যাত্রী হচ্ছে না। ১৬০ আসনের ফ্লাইটে যাত্রী হয় ৪০ থেকে ৬০ জন। এ নিয়ে কোনো অফিসের স্টেশন ম্যানেজার, কান্ট্রি ম্যানেজারের বিরুদ্ধে সাধারণ কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না।
এদিকে সিদ্ধান্তহীনতায় যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানিতে নির্মাণাধীন দুটি উড়োজাহাজের জন্য এখনও ইঞ্জিন সিলেকশন করা হয়নি বলে জানা গেছে। এ কারণে ২০১৮ সালে বিমান বহরে এ দুটি উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/10/116469/