১৯ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:৫৫

মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারসাজি

পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও অস্থির চালের বাজার

এক মাসের ব্যবধানে বস্তায় বেড়েছে ৪০০ টাকা * দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ * এই মুহূর্তে দেশে ধান চালের সংকট নেই -কৃষিমন্ত্রী

পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। বরং আমন মৌসুমে হু হু করে বাড়ছে দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এই বাড়তি দর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা সমন্বয় করছেন। ফলে চাল কিনতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় ক্রেতাসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়ছে।

মঙ্গলবার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পণ্য মূল্য তালিকায় এই দর লক্ষ্য করা গেছে। এখন রাজধানীর খুচরা বাজারে একজন ক্রেতাকে প্রতিকেজি চাল (মোটা জাতের) কিনতে ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। টিসিবি বলছে, মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি মোটা চাল ২ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর গত বছর একই সময়ের তুলনায় বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি দরে। পাশাপাশি মাঝারি আকারের প্রতিকেজি চাল মাসের ব্যবধানে ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও গত বছর একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরু চাল মাসের ব্যবধানে ১ দশমিক ৫৯ ও গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘গত বছর থেকেই চালের দাম বাড়তি। সবার ধারণা ছিল আমন মৌসুমে দাম স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে চাল। তাই ক্রেতা তথা নিম্ন আয়ের মানুষের আরও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। চাল কিনতে অতিরিক্ত এই ব্যয়ের প্রভাব অন্যান্য চাহিদার ওপর পড়ছে। তাই চালের দাম কমাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। তদারকি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

মঙ্গলবার নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা, যা এক মাস আগেও ২৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া বিআর-২৮ চাল প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৫৫০-২৬০০ টাকা, যা এক মাস আগে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বস্তায় এই জাতের চালের দাম ৪০০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মিলারদের কারসাজিতে পুরো বছর ধরে চালের দাম বাড়তি। নানা অজুহাতে তারা দাম বাড়িয়েছে।

কখনো সরবরাহ সংকট, আবার কখনো ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ আমন মৌসুমে সংকটের কথা বলে আবারও চালের দাম বস্তায় সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারি পর্যায়ে বেশি টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি জানান, যে মিনিকেট চালের বস্তা এক মাস আগে ২৮০০ টাকায় বিক্রি করতাম, তা এখন ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিআর-২৮ চাল পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করতাম ২২০০ টাকা, যা এখন ২৪০০-২৪৫০ টাকায় বিক্রি করছি। ফলে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি আরও জানান, এতদিন শুধু মিলারদের কারণে চালের দাম বেড়েছে। এবার যুক্ত হয়েছে মৌসুমি ধান বিক্রেতা। তারা করোনাকালে অন্যান্য ব্যবসায় ধরা খেয়ে ধান ব্যবসায় ঝুঁকেছে। কৃষকের কাছে কম দামে ধান কিনে বাসাবাড়িতে এমনকি গোপনে গোডাউন ভাড়া নিয়ে ধান মজুদ করে রেখেছে। কারণ চাল মজুদ করা যায় না। নষ্ট হয়ে যায়। আর ধান নষ্ট না হওয়ায় মজুদ করে রাখা যায়। যে কারণে মজুদকৃত ধান বিক্রি করছে বাড়তি দরে। ফলে এই বাড়তি দরের প্রভাব চালের বাজারে গিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ মেজর ও অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও মিল মালিক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন জানান, চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল প্রসেসিংয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। যে কারণে মিল পর্যায় থেকে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, কৃষকদের পাশাপাশি ধানের মৌসুমি ব্যবসায়ী এখন ধান মজুদ করছে। দাম বেশি না হলে তারা বাজারে ছাড়ছেন না। এ কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চালের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। বাজারে পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে বর্তমানে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে। গমের দাম বাড়লে চালেরও দাম বাড়ে। তিনি জানান, দেশে ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। প্রতিবছর ২২-২৪ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। এ ছাড়া অ্যানিমেল ফিড হিসাবেও চালের কিছু ব্যবহার হচ্ছে। এসব বিষয় ও কিছুটা মুদ্রাস্ফীতির ফলে চালের দাম বেশি। কিন্তু বাজারে গেলে চাল পাওয়া যায় না বা মানুষ কিনতে পারে না এমন পরিস্থিতি নেই। এই মুহূর্তে দেশে খাদ্যসংকট নেই।

রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিকেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। বিআর-২৮ চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। মোটা জাতের মধ্যে স্বর্ণা চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। রাজধানীর কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা হাবিবুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম বাড়ায় অন্যান্য তরিতরকারি কিনতে টানাটানি পড়ছে। কিন্তু বাজারে কোনো ধরনের চালের সংকট নেই। দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো চালের বস্তা। কিন্তু কিনতে হচ্ছে বাড়তি দরে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, মিল থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/510552