১৯ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:৫৩

শুরুতেই সঙ্কটে ঢাকা নগর পরিবহন

বাসে বাসে প্রতিযোগিতা আগের মতোই

কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে ঢাকা নগর পরিবহনের প্রথম স্টপেজে সারি সারি সবুজ রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটি গাড়িতে দেখা গেল ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ লেখা স্থানের সাদা রঙ উঠে গেছে। জানতে চাইলে একজন চালক বলেন, এ রুটে আগের যে বাস চলাচল করত তারা অবৈধভাবে অন্য নামে বাস চালাচ্ছে। তাদের চালকরা আমাদের গাড়িকে নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। প্রতিযোগিতা করে সামনে যাচ্ছে, আবার সামনে গিয়ে বাস আড়াআড়ি করে রেখে দিচ্ছে। যাতে আমরা যাত্রী তুলতে না পারি। খেয়াল করলে আরো কয়েকটি গাড়ির নতুন রঙ ঘসা খেয়ে উঠে যেতে দেখা যায়। কোন কোন গাড়ির বডিও দেবে গেছে।

রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরীক্ষামূলকভাবে একটি রুটে চালু হয়েছে ঢাকা নগর পরিবহন। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে যাত্রা শুরু করে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ২৭ কিলোমিটার চলছে বাস। তবে এক মাসও না পেরোতেই নানা সঙ্কটে পড়েছে এ উদ্যোগটি। সংশ্লিষ্ট রুটে অবৈধ গাড়ি চলাচল করায় আগের মতোই প্রতিযোগিতা রয়ে গেছে। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষতি, স্টপেজ দূরে হওয়া, যত্রতত্র যাত্রী নামা, চালক-হেলপারের ঘাটতি, তাদের খাবারের টাকা না দেয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। তবে এত সঙ্কটের মধ্যেও সেবার মান এখনো ভালো আছে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। কম টাকায় ভালো সেবা পাওয়ায় তারা খুশি। তবে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনাগুলো দূর করতে পারলে এ সিস্টেম নগর পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারবে বলে আশা করেছেন যাত্রী-চালকসহ সংশ্লিষ্টরা।

বাস রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে গত ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে ৫০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা নগর পরিবহন। এ রুটে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর ডিপো থেকে বাস ছেড়ে বসিলা, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শংকর, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, মৎস্যভবন, প্রেস ক্লাব, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, নটর ডেম কলেজ, ইত্তেফাক মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, চিটাগং রোড হয়ে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত যাচ্ছে। রুটে বিআরটিসির ৩০টি দ্বিতল বাস ও ট্রান্স সিলভা পরিবহনের ২০টি বাস রয়েছে। পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে মোট ১০০টি বাস নিয়ে পুরোদমে এর কার্যক্রম চালু হবে বলে তখন জানায় কর্তৃপক্ষ। তবে চালুর মাত্র ২৪ দিনের মাথায় সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে এ রুটে বিআরটিসির ৩০টির বদলে ২০টি ডাবল ডেকার এবং ট্রান্স সিলভা পরিবহনের ২০টি বাস চলাচল করছে। ঘাটারচর প্রথম স্টপেজে দেখা যায়, প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর ট্রান্স সিলভা পরিবহনের সবুজ রঙের একতলা বাস এবং ১০ মিনিটি পরপর বিআরটিসির দ্বিতল বাস ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে গাড়িতে উঠছেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। শুরুর স্টপেজে পাঁচ থেকে ১০ জনের মতো যাত্রী উঠছেন। তবে পরে আস্তে আস্তে গাড়িতে যাত্রী বাড়তে থাকে। সকালে স্কুল-কলেজ ও অফিসগামী যাত্রী ভর্তি থাকে এবং সন্ধ্যায় অফিস শেষে যাত্রী সিট ছাড়াও দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেন। তবে অন্য সময় যাত্রী কম থাকে বলে কয়েকজন চালক জানান।

বাসচালক রেজাউল বলেন, বিআরটিসি আমাদের মাসিক বেতন দেয়। আমাদের ৮ ঘণ্টা ডিউটি করার কথা। কিন্তু আমাদের একটানা প্রায় ১২-১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হচ্ছে। মোট চারবার যাতায়াত করতে হয়। খাওয়ার জন্য টাকা দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে না। নিজেদের পকেট থেকে খাবার খেতে হচ্ছে। এতে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রান্স সিলভার গাড়িতে হেলপার থাকলেও বিটিআরসির গাড়িতে কোনো হেলপার নেই। এতে যাত্রীদের ওঠানামায় সমস্যা হয়। অনেক সময় যাত্রীরা এক জায়গার নামে টিকিট কেটে আরেক জায়গায় নামছে। এতে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে আরেক চালক বলেন, এ রুটে আগে রজনীগন্ধা নামে একটি পরিবহন চলত। তারা এখন নাম পরিবর্তন করে টি থ্রি পরিবহন নামে চালাচ্ছে। তাদের চালকরা আমাদের গাড়িকে নানাভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। গাড়ি আড়াআড়িভাবে সামনে দাঁড় করিয়ে তারা আগে যাত্রী ওঠায়। এ ছাড়া মিডলাইন, পরীস্থানসহ আরো বেশ কিছু গাড়ি এ রুটে চলছে।

আরেক বাসচালক বলেন, নির্ধারিত স্টপেজ থাকার কারণে যাত্রীরা টিকিট কেটেই গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু নামার সময় তারা স্টপেজে নামতে চান না। যাত্রীরা তাদের ইচ্ছামত জায়গায় নামাতে বলেন। না নামালে মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করেন। ফলে বাধ্য হয়ে স্টপেজের বাইরে তাদের চাহিদামত জায়গায় নামিয়ে দিতে হয়।

ঘাটারচরে দায়িত্বরত লাইনম্যান আসাদুজ্জামান বলেন, ভোর ৫টায় আসি। সকাল ৭টা ২০-২৫ মিনিটে প্রথম গাড়ি ছাড়ি। সব কাজ শেষ করে যেতে হয় রাত ৯টায়। সারা দিন নিজের পকেট থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। তিনি আরো বলেন, ঘাটারচর, ওয়াশপুর ও বসিলা স্টপেজে কোনো বাতির ব্যবস্থা নেই। এতে রাতে অন্ধকারে কাজ করতে হয়। খোলা জায়গায় কাউন্টার থাকায় ধুলাবালিতে সমস্যা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এতে নিরাপত্তা সঙ্কটও রয়েছে। একটি টিকিট কাটার ঘর থাকলে ভালো হতো।
ওয়াশপুরে দায়িত্বরত লাইনম্যান নাঈম হোসেন বলেন, আমাদের বাস ভাড়া অন্যান্য বাসের চেয়ে কম। কারণ, আমরাই একমাত্র রুট পারমিট অনুযায়ী ভাড়া নিই। যেখানে ভাড়া ১২ টাকা, সেখানে আমরা ১২ টাকাই নিই। অন্যরা নেয় ১৫-২০ টাকা। আর শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া দিতে পারছে। খুব কম টাকায় স্কুল-কলেজে যেতে পারছে।

নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অনামিকা ইসলাম জানান, নতুন এ সার্ভিস বেশ ভালো। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিচ্ছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
কামাল উদ্দিন নামে আরেক যাত্রী বলেন, নুতন এ সার্ভিস বেশ ভালো। সময় নষ্ট হয় না। নির্ধারিত স্টপেজে নামাচ্ছে। তবে জানি না কত দিন এভাবে ভালো সার্ভিস অব্যাহত থাকবে। কারণ এ রকম অনেক উদ্যোগ প্রথমে ভালো থাকলেও পরে ঠিক থাকে না।
রুমানা নামে এক যাত্রী বলেন, বাসে, কাউন্টারে কোথাও ভাড়ার চার্ট টাঙানো নেই। চার্ট থাকলে মানুষ সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা পেত। যাত্রীরা স্টপেজে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন, বসার জায়গা থাকলেও তা ময়লা। বসা যায় না। আশপাশেও অনেক ধুলাবালি। এছাড়া বাসে উঠে অনেক যাত্রী নিয়ম মানতে চায় না। তারা যেখানে সেখানে নামতে চায়। চালকের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আবার হেলপার না থাকার কারণেও সমস্যা হয়।

ট্রান্স সিলভা পরিবহনের মালিক সৈয়দ রেজাউল করিম খোকন নয়া দিগন্তকে বলেন, এ রুটে আমাদের ২০টি গাড়ি চলাচল করছে। হেলপারসহ আমাদের স্টাফ আছে মোট ৫০ জন। তাদের বেতন, জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ মাসে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু যে টাকা আয় হচ্ছে তাতে প্রতিদিন এক লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো লস হচ্ছে। বিটিআরসির দ্বিতল বাসে লস প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। আমাদের এখন ডিজেল কেনার টাকা নেই। মাস শেষে চালক-হেলপারদের বেতন দিতে পারব কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, রুটে অবৈধ গাড়ি চলছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এতে যাত্রীসঙ্কট হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, লস কাটাতে হলে আমাদের আরো বাস নামানোর সুযোগ দিতে হবে। তাহলে ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে একটি উদ্যোগ অনেক সাড়ম্বরে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু পরে আর সেটি সঠিকভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না। এভাবে হলে এটিও টিকবে না। এ পদ্ধতি সফল করতে হলে রুটে অন্য বাসের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। তাহলেই রুট-ভিত্তিক এ পদ্ধতি কার্যকর হবে।

এ ব্যাপারে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন এ সার্ভিস চালুর পর আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি। আমরাও বেশ কিছু সমস্যা দেখতে পেয়েছি। এগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি ৫০০ মিটার পরপর আমাদের স্টপেজ রয়েছে। তবে এখনো সাতটি যাত্রীছাউনি নির্মাণ বাকি রয়েছে। রুটে অন্য বাস চলছে। এ জন্য রুটটি এখনো লসে আছে। তবে এটা যেহেতু সেবা, সে ক্ষেত্রে সরকার এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেবে। তিনি বলেন, সঙ্কট কাটাতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে টাটা কোম্পানির আরো ৬০টি নতুন গাড়ি এ রুটে যুক্ত হবে। বাস মালিকসহ সব পক্ষের মধ্যে এখনো যৌথ চুক্তি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এটি করার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া বাসে কিউআর কোড বসানো হবে। রুট-ভিত্তিক বাস পরিচালনায় অনেক বড় কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে বলেও তিনি জানান।

২০১৮ সালে ঢাকা শহরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করে সরকার। প্রথমে ছয়টি কোম্পানির অধীনে ঢাকার ২২টি রুটে সব বাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তীতে রুট নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২টি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে পরীক্ষামূলকভাবে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে সাড়ে ২৭ কিলোমিটার পথে এটি চালু করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/637570