১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৮:৩৯

এ কেমন বন্ধু ভারত?

টক অব দ্য টিভি টকশো

|| রাজনৈতিক ভাষ্যকার || পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও জাতিগতভাবে বিশ্বের অনেক ধনী দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক উচ্চতায়। জাতি হিসেবে সেটা শ্লাঘার বিষয় বটে। সেই শ্লাঘায় কী আঘাত ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা? ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, সিডর, আইলা, মহামারিতে কোনো জাতি ধ্বংস হয় না। ধ্বংসের বীজ থাকে তার নিজ ইতিহাসে। আত্মহননের সে বীজ থেকে জন্ম নেয় জনগণের মাঝে আত্মঘাতী ঘৃণা। সে ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় রক্তক্ষয়ী হানাহানি। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যতই বিষপূর্ণ ইতিহাস পাঠ করানো হয় জনগণের মাঝে ততই বিরোধ-ঘৃর্ণা বাড়ে। মানুষ অন্ধকারে থাকার বদলে জানতে চায় তার আপন পরিচয়। গেøাবালাইজেশনের যুগে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব অপরিহার্য; কিন্তু বন্ধুত্বের মোড়কে বসগিরি মানুষ পছন্দ করে না। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে প্রতিটি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মসম্মান ও জাতীয় বিজয় আসে নাগরিকদের একতার পথ ধরে। বিভক্তির মধ্যে আসে আত্মহনন, আত্মগøানি। বাংলাদেশ কী সেই বিভক্তির পথ ধরেই অগ্রসর হবে? সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার চেয়ে ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার কলাকৌশল যদি দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য হয়; তার চেয়ে একটি দেশের জন্য বড় আত্মঘাতী আর কি হতে পারে? বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হওয়ার পর দেশের টিভিগুলোতে বিভিন্ন টকশোর আলোচকরা কথাবার্তায় সে প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কয়টি চুক্তি ও কয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। চুক্তির ভেতরে কি আছে তাও অজানা। তবে এ চুক্তি-সমঝোতা দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি দেশের বেসরকারি টিভিগুলোর টকশো’য় প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। সর্বত্রই একই আলোচনা-সমালোচনা বিতর্ক। তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রায় সবাই।
ঢাকা থেকে যেসব বেসরকারি টিভি সম্প্রচার হয় তার অধিকাংশতেই টকশো প্রচার করা হয়। রাতে নানা নামে প্রচারিত ওইসব টকশোতে দিল্লি-ঢাকার চুক্তি নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। বছরের পর বছর তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা এবং প্রতিরক্ষা চুক্তিসহ কিছু চুক্তি ও সমঝোতায় দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে যেন রক্তক্ষরণ চলছে। এনটিভি, এসএ টিভি, এটিএন, নিউজ টুয়েন্টি ফোর, যমুনা, মাছরাঙ্গা, দেশ টিভি, মাইটিভি, চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি, গাজী টিভি, এশিয়া টিভি, বৈশাখী টিভি, চ্যানেল আই, বাংলা ভিশন, দীপ্ত টিভিসহ কয়েকটি টিভির টকশো’য় অংশ নেয়া বিশিষ্টজনদের বক্তব্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা যায়। আলোচকরা যেমন প্রতিবেশী দেশ ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন; তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেন। দেশের স্বাতন্ত্র্যতা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, দেশপ্রেমী সেনাবাহিনী, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রæতা নয়’ নীতি অনিশ্চয়তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দু’চারজন আলোচক ভারত পরীক্ষিত বন্ধু দাবি করলেও অধিকাংশ আলোচকই ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য ভারত ৪৫ বছরেও বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারেনি। বরং বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নতজানু মানসিকতার সুযোগ নিয়েছে ভারত। আর কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র দমোদর দাস মোদী’র চাতুর্যপনাকে বিশেষ সম্মান হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বক্তারা কোনোভাবেই তিস্তা চুক্তির সঙ্গে অন্য কোনো চুক্তিকে মেলাতে রাজি নন। তাদের বক্তব্য তিস্তার পানি আমাদের পাওনা। ২০১১ সালে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির কাগজপত্র চূড়ান্ত ছিল। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসে অচিরেই তিস্তা চুক্তির প্রতিশ্রæতি দেন। তারপরও তিস্তা ঝুলিয়ে রাখা বন্ধুত্বের কোনো নিদর্শন হতে পারে না।
দিল্লি-ঢাকা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির চাতুর্যতাই প্রকাশ পেয়েছে এমন মত প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ড. রওনক জাহান বলেন, ভারতকে ভাবতে হবে তারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কি করতে পারে। যা করলে এ দেশের মানুষ মনে করবে ভারত আগ্রাসী নয়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকে আরো উদার হতে হবে। তিস্তার পানি দিচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ভারত বিরোধী কার্ড ব্যবহার করতে না পারে সে জন্যই দিল্লিকে বাংলাদেশকে কিছু দিতে হবে। শুধু নেব কিছুই দেব না এটা হয় না। সাবেক কূটনীতিক আশফাকুর রহমান বলেন, ভারত বাংলাদেশের চুক্তিতে নগদ প্রাপ্তি নির্ভর করে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর। কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে ভারত সত্যিই বন্ধুত্ব চায় না নিজেদের স্বার্থে এসব চুক্তি করছে। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার প্রতিরক্ষা সমঝোতার বিরোধিতা করে ভারত থেকে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির সমালোচনা করে বলেন, ভারত নিজেই ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে ইসরাইল থেকে। বিশ্বের ১০ অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ভারত নেই। যারা বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনে তাদের কাছে আমাদের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির প্রয়োজন আছে কিনা ভাবতে হবে। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক। কিন্তু বন্ধুত্ব হতে হয় সমমর্যাদার, অভিভাবকত্বের নয়। বিগ ব্রাদার ভাব চলবে না। দুই দেশের যে সব চুক্তি হয়েছে সেগুলো নিয়ে রাখঢাকই আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংকট নিরসন করেছে। অন্যকোনো দেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের ঘাটতি পড়লে কি আমাদের পররাষ্ট্র নীতি পাল্টিয়ে ভারতের পক্ষে থাকতে হবে? এ সম্পর্কে খোলাসা হওয়া দরকার। ’৭১-এ চুক্তি ছাড়াই ভারত আমাদের সহায়তা করেছে; এখন চুক্তির প্রয়োজন পড়লো কেন? আস্থার ঘাটতি দূর করতে হবে। আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হবে; অন্য দেশের প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে নয়। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সমশের মবিন চৌধুরী বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে চুক্তি হতে পারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা না করে চুক্তি করেছেন এমন মনে করছি না। সামরিক বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কমন শত্রæ থাকলে দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি হয়। যেমন ন্যাটো। প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের প্রয়োজন আমাদের নয়। মনোহর পারিকর ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল; সে প্রস্তাবে কি ছিল জানি না। চীনের সাবমেরিন কেনার পর চায়না তাদের ট্রেনিং দেবে ভারত এটা মেনে নিতে পারছে না। ভারত অস্ত্র তৈরি করে না; তারা আমাদের কি অস্ত্র দেবে? রাশিয়ার তত্ত¡াবধানে নির্মিতব্য পারমাণবিক চুল্লির ভারত তত্ত¡াবধান করতে চায়। ভারতের নিউক্লিয়ার্স নেয়ার দেশ নেই। তারা বাংলাদেশে সেটার বাজার সৃষ্টি করতে চায়। আমাদের যে অস্ত্রের প্রয়োজন সেটা ভারতের নেই। তাহলে তাদের অস্ত্র কেন কিনতে হবে?
ভারত ৪৪ বছরেও বন্ধুত্বের নিদর্শন দিতে পারেনি অভিমত ব্যক্ত করে সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবির বলেন, ভারত বন্ধুত্ব নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর প্রতিদান হিসেবে প্রতিরক্ষাসহ অনেকগুলো চুক্তি করেছে। আমাদের শাসক শ্রেণির দুর্বলতা, মেরুদÐহীনতার সুযোগ নিচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব যতই উচ্চতায় দাবি করা হোক না কেন আমি দেখি সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ। কারণ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভারতকে বিশ্বাস করে না। সরকারের দুর্বলতার কারণে চুক্তিগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা সড়ক পথে নেপাল-ভুটানে যেতে চাই। ভারত পথ দেয় না। অথচ তারা ট্রানজিট নিয়েছে। ’৭২ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈরিতার সম্পর্ক। স্বাধীনতার জন্য আমরা সশ¯্র যুদ্ধ করলে ভারত সে সুযোগ নেয়। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ভারত অপ্রতিদ্ব›দ্বী জায়গায় যেতে চেয়েছে। আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি আর ভারত শক্তি বৃদ্ধি চেয়েছে। অতঃপর বন্ধুত্বের নামে ভারত নিপীড়ন করছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা মাথা বিক্রি করায় ভারত যা ইচ্ছে তাই করছে। দিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে অথচ দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবীরা আজ কোথায়? আমরা যতদিন জাতীয় ইস্যুতে এক হতে না পারব ততদিন ভারতের হাতে শোষিত হতেই হবে। হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্রমোদির হটকারী এবং চানক্যে খুশি হওয়ার কিছু নেই।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে যা আলোচনা হয় তার বেশিরভাগই প্রকাশ করা হয় না। বাংলাদেশ থেকে কিছুই বলা হয় না আমাদের জানতে হয় ভারতের পত্রিকা থেকে। বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সুবিধা করতে পারেনি। ২২ চুক্তির মধ্যে ক্লিনিক নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের কি ক্লিনিক নির্মাণের সক্ষমতা নেই? আমাদের বিচার বিভাগ নিয়ে ২টি চুক্তি হয়েছে। কেন? ভারত কীভাবে আমাদের বিচার বিভাগের সহায়তা করবে? তিস্তার পানি না দেয়ার ভারতের চানক্যের ফাঁদে পড়ে গেছি। দীর্ঘদিন তিস্তা ঝুলিয়ে রেখে ভারত কি বন্ধুত্বের পরিচয় দিচ্ছে?
বাংলাদেশের আমলাদের দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ড. সা’দত হোসাইন বলেন, যে কোনো বিষয়ে চুক্তির আগে ভারতের কর্মকর্তারা পড়াশোনা করেন; সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে বৈঠকে বসেন। চুক্তিতে একটি শব্দের প্রয়োজনে তারা একদিন সময় নেন। অথচ আমাদের পক্ষে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তারা চুক্তির বিষয়াদি ও ধারা নিয়ে তেমন জানেনই না। যার কারণে ভারত সব চুক্তিতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। ১০ বছরে চীন অনেক উপরে উঠে গেছে। ৪ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খারাপ। অরুণাচল প্রদেশে, দালাইলামার ভারত সফর ইস্যু নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্ব›দ্ব। অথচ চীন আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযোগী চীন। এ অবস্থায় আমরা চীনসহ কোনো দেশের জন্য হুমকি হতে পারি না। প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে সে জন্য বিতর্ক উঠেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সামরিক চুক্তিতে স্পর্শকাতরতা নেই। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্যই বিরোধিতা করা হচ্ছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উন্নত হয়েছে। ভারত বড় দেশ। তারপরও আমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। তবে দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি হওয়া উচিত ছিল। সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির বলেন, শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একান্তে অনেক আলাপ হয়েছে। বর্ডার কিলিংসহ অনেক ইস্যু উঠে এসেছে। তবে ফেলানীর খুনিদের ফাঁসি না দেয়ায় অবাক হয়েছি। সাবেক এমপি এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর বলেন, ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করার কেন প্রয়োজন পড়ল সেটাই বুঝতে পারছি না। চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা থাকলে সেখানে আমাদের পক্ষ হতে হবে কেন? কি চুক্তি হয়েছে সেগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি বাদ দিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি সন্দেহের জন্ম দেয় যারা এসব করছেন তারা কী ঢাকার স্বার্থের চেয়ে দিল্লির স্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি? যুগের পর যুগ ধরে দাবি করে তিস্তা চুক্তি পাচ্ছি না অথচ ভারত দু-তিন মাস আগে প্রতিরক্ষা চুক্তির দাবি করে সেটা পেয়ে গেল। এতেই প্রমাণ হয় ভারত আমাদের কোনো বন্ধুই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়তো চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাংলাদেশের জন্য কিছুই আনতে পারেননি। আর মোদি যা চেয়েছে সবগুলো পেয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দুর্বলতা রয়েছে। দুই দেশের ভালো সম্পর্ক থাকলে এক দেশের চাহিদা পূরণ হয় অন্য দেশের চাহিদা পূরণে গরিমসি কেন? ভারত যে আশ্বাস চায় তা বাংলাদেশ পূরণ করে; কিন্তু বাংলাদেশ চাইলে তা নিয়ে বাহানা করা হয়। আমরা কার্যত ভারত থেকে প্রতিবেশী সুলভ কোনো ভালো আচরণ পাচ্ছি না। সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনেকগুলো চুক্তির মধ্যে তিস্তা চুক্তি না হলে আমার কিছুই যায় আসে না’। আমার ভাবতে অবাক লাগে এরাই আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? এরা কারা? তিস্তার পানি আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রেখেছে। ৫৪ অভিন্ন নদীর পানির সুরাহা করছে না। সাবেক কূটনীতিক নাসিম ফেরদৌস বলেন, এখন কোনো দেশকে একঘরে থাকার সুযোগ নেই। চুক্তি কি হয়েছে সেগুলো দেখার পর মন্তব্য করা উচিত। দুই দেশের চুক্তিতে খারাপ কিছু দেখি না। ট্রুথ পার্টির মহাসচিব এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, তিস্তা চুক্তি ছাড়া অন্য চুক্তিগুলো বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয়। আমাদের সেনাবাহিনী সারাবিশ্বের সাফল্য দেখাচ্ছে। তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে কি প্রতিরক্ষা চুক্তি?
ভারতকে বিশ্বাস করা যায় নাÑ এমন অভিমত ব্যক্ত করে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ভারত বন্ধু। তবে সে বন্ধুত্ব হুমকির মুখে। চুক্তিতে কি আছে না দেখে মন্তব্য করতে চাই না। তবে ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষের মনোজগত দেখা। ভারত তার সবকিছু প্রাপ্য বুঝে নিল আর আমাদের কিছুই দেবে না এটা বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়। অতীতে যে চুক্তি হয়েছে সবগুলো ভারতের স্বার্থে। একতরফা সহযোগিতায় বন্ধুত্ব হয় না। তিস্তা চুক্তি বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। নতুন করে প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজন পড়ল কেন? দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলো দেখে মনে হয় তারা দুই দেশের স্বার্থে নয় তারা কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থে সংলাপ করছেন। সামরিক চুক্তির কারণে আমেরিকার তাঁবেদারি করতে বাধ্য ভারত। আমাদের কি সেটা ভারতের সঙ্গে করতে হবে? নরেন্দ্র মোদি যেভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উস্কে নিচ্ছে তাতে ভারতের সঙ্গে যে কোনো চুক্তি এবং সম্পর্ক রাখা ভয়ের কারণ। সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম বলেন, মানুষের প্রত্যাশা ছিল ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি হবে। কিন্তু সে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হলো। চুক্তিতে কি আছে তা কেউ জানেন না। মানুষ মনে করছে আমরা ঠকছি। কারণ আমাদের সরকার রাখঢাক করছে। প্রতিরক্ষা নিয়ে শঙ্কা থাকার কথা নয়। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি আমাদের শঙ্কায় ফেলেছে। অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক যে সব চুক্তি হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ভারত ঋণ দেবে; সে ঋণের টাকায় আবার ভারত থেকে অস্ত্র কিনতে হবে। আমাদের কি অস্ত্র প্রয়োজন আর তারা কি অস্ত্র দেবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। অনেকগুলো চুক্তি হয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জাতিসংঘের পানি বিশেষজ্ঞ আহসান উদ্দিন আহমদ বলেন, তিস্তা চুক্তি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান না করে অন্য চুক্তিতে বাংলাদেশের মানুষ আগ্রহী নয়। পানির অভাবে যেভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে তাকে তিস্তার পানি না পেলে উত্তরাঞ্চল মুরুভূমি হয়ে যাবে। তিস্তার পানির সঙ্গে অন্যকোনো চুক্তির সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে তিস্তার নদীর ওপর নির্ভরশীল ৩ কোটি মানুষ; ভারতে ৫০ লাখ। সে চুক্তি ঝুলে রেখে কি বন্ধুত্বের নিদর্শন রাখছে? সিনিয়র সাংবাদিক আমির খসরু বলেন, জাতীয় নিরাপত্তায় আমার সিদ্ধান্ত আমি নেব; সেখানে ভারত কেন? ভারত বিদেশ থেকে আমদানি করে অস্ত্র। ভারত থেকে অস্ত্র কিনেছিল মিয়ানমার ও নেপাল। কয়েকদিন পর সে অস্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ভারত নিজেই রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় করে। ইসরাইল থেকে অস্ত্র আনে। সেখানে আমাদের তারা কি অস্ত্র দেবে? আর বিদেশ থেকে অস্ত্র কিনলে কি আমাদের ভারতের মধ্যস্থতায় কিনতে হবে? প্রতিরক্ষা চুক্তি বলেন আর সমঝোতা স্বারক বলেন এটা হয়েছে দেশবিরোধী। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলে দেবে এ চুক্তি। এ চুক্তি যে ভারতের স্বার্থে হয়েছে সেটা বোঝা যায় সরকারের লুকোচুরি দেখে। বর্তমান সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে কি চুক্তি হয়েছে সবগুলো প্রকাশ করা। ভারতের চাপিয়ে দেয়া কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষ মানবে না। সাংবাদিক সালেহ উদ্দিন বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যদি বড় অঘটনে সেনাবাহিনী অভিযান চালায় সেখানে কি ভারতের সেনাবাহিনী এসে অংশ নেবে? তাহলে কি দেশের সার্বভৌমত্ব থাকবে? বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে কি ভারত তাদের দেশে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে দেবে? আমাদের সেনাবাহিনীর নিজস্ব কর্মকৌশল কি ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে? আমাদের সার্বভৌমত্ব থাকবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবে ভারত? অধিকাংশ আলোচক তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন ভারত এ কেমন বন্ধু? ভৌগলিকগত সুবিধায় অন্যায়ভাবে উজানে তিস্তার পানি তুলে নিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাকে মরুভূমির পথে ঠেলে দিচ্ছে?

https://www.dailyinqilab.com/article/74122/