১৭ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ১২:৪৪

ইভিএম সমস্যায় ভোটে ধীরগতি অসন্তোষ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয় ভোটগ্রহণ। কারচুপি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। তবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে ভোটারদের অভিযোগের অন্ত নেই। নাসিকের বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও মেশিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোথাও আবার হাতের ছাপ না মিলা, সাবান ও ভ্যাসলিন দিয়ে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মিলে আঙুলের ছাপ। আবার কোনো কেন্দ্রে নষ্ট হয়ে যায় মেশিন। ভোটার ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভিএমের কারণে শ্লথ হয়ে যায় ভোট পড়ার হারও। আবার অনেক কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন ভোটাররা। ভোটের স্লিপের সঙ্গে মেলেনি জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর। আবার কোথাও স্লিপ নিয়ে এক বুথে যাওয়ার পর বলা হচ্ছে অন্য বুথে যেতে। এমন নানা হয়রানির মধ্যে পড়েন ভোটাররা। বিশেষ করে মহিলা ভোটারদের ভোগান্তি ছিল চরমে। কেউ কেউ ক্ষোভ জানিয়ে ভোট না দিয়েই কেন্দ্র ত্যাগ করেন। তবে যারা অপেক্ষা করেছেন, নির্ধারিত সময়ের পরও তাদের ভোট নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের বন্দর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট না দিয়েই ফিরে যান মাসুদা খাতুন ও রাজিয়া সুলতানা। অনেক চেষ্টা করেও তাদের আঙুলের ছাপ না মেলায় তাদের ভোট নেননি সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ভোট দিতে ব্যর্থ হয়ে ১২টা ১৫ মিনিটে তারা ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার সময়ে মাসুদা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, আমার ডান হাতের কয়েকটি আঙুল কেটে যাওয়ায় অর্ধেক অংশ নেই। ওই কারণে বাম হাতের আঙুল দিয়ে চেষ্টা করেও আমার তথ্য ইভিএমে আসেনি।

আমাকে বিকাল ৩টার পর আসতে বলেছে। আমি আর আসব না। এ সময় তার সঙ্গে থাকা বান্ধবী রাজিয়া সুলতানা বলেন, আমার সব আঙুল আছে। তবুও আমার তথ্য আসেনি। ৫-৬ বার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট দিয়েছি। কখনোই সমস্যা হয়নি, এবার হলো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বয়স্কদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হচ্ছে। অনেকের আঙুলের রেখা মুছে যাওয়ায় তা রিডিংয়ে সমস্যা হচ্ছে। এমন ভোটারদের বিকাল ৩টার পর আসতে বলেছি। তখন কীভাবে ভোট নেওয়া যায় সেটা চেষ্টা করব।

নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুপুর সাড়ে বারোটায় গিয়ে দেখা যায়, লাইনে অনেকে থাকলেও ভোট কাস্টিং ছিল শ্লথ। ভোটকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ফিঙ্গার প্রিন্ট না মেলায় অনেকে একাধিকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, বয়স্ক ভোটারদের নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে অভ্যস্ত নন। তবে আমরা তাদের শিখিয়ে দিচ্ছি। ভোট দিতে সাহায্যও করছি। যাদের আঙুলের ছাপ মিলছে না তাদের ভ্যাসলিন দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে।

সরেজমিন বন্দরের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সকাল আটটায় ভোট শুরু হলেও সেখানে ইভিএম মেশিনে দেখা দেয় ত্রুটি। বন্দরের একরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারেননি তারা। রাবেয়া নামের এক মহিলা বলেন, সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দাঁড়িয়ে থেকেও ভোট দিতে পারছি না। অন্য লাইনের ভোটাররা ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছে, আমাদের লাইন আগায় না। এ কেন্দ্রে শুরুতেই ইভিএমে সমস্যা তৈরি হয়।

একই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা মহিলারা আরও কিছু অভিযোগ করেন। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে বুথে ঢোকার পর বলা হচ্ছে, আপনার ভোট এখানে নয়। পুনরায় অন্য বুথে নতুন করে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে।

রহিমা আক্তার নামের একজন ক্ষোভের সঙ্গে জানান, সকাল ৮টার সময় লাইনে দাঁড়িয়েছি। দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর বলে এখানে ভোট না, সাততলায় যান। আমি রোগী মানুষ ভোটই দিতাম না।

বন্দরের ৪৩নং লক্ষণখোল দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেন্দ্রের সামনে দীর্ঘ লাইন। ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। এক ঘণ্টায় মাত্র কয়েকটা ভোট কাস্ট হয়েছে। সুমন নামে এক ভোটার বলেন, ৩ ঘণ্টা ধইরা দাঁড়ায় আছি। শেষ ৪০ মিনিটে আমার সামনে থেকে মাত্র ৩ জন গেছে। তাও একজন এখনো ভোট দিতে পারেন নাই। এ বিষয়ে প্রিসাইডিং অফিসার মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, মেশিন ঠিকভাবেই কাজ করছে। কিন্তু অনেকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় এই ভোগান্তি হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তিনটি কেন্দ্রে বেশির ভাগ নারী ভোটারই পঞ্চাশোর্ধ্ব। তাদের আঙুলের ছাপ মেলাতে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। অনেকের আঙুলের ছাপ একেবারেই মিলছে না। রোকেয়া বেগম নামের এক মহিলা বুথে ঢোকার পর আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে পারেননি। পরে আবার চেষ্টা করবেন বলে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে আবার গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আঙুলের ছাপ মিললে তিনি ভোট দেন। প্রিসাইডিং অফিসার রাজিব সাহা বলেন, ভোটে ধীরগতি রয়েছে। এর কারণ ইভিএম মেশিনে নারী ভোটারদের আঙুলের ছাপ মেলাতে দেরি হচ্ছে। কারণ ২০০৮ সালের হালনাগাদ তথ্যই দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাই অনেকের আঙুলের ছাপ মিলতে দেরি হচ্ছে। একজন ভোটার ৬-৭ বার আঙুল দেওয়ার পর মেশিন তা নিচ্ছে। আবার অনেকেরটা নিচ্ছে না। সকাল ১১টার দিকে শহরের আদর্শ স্কুল নারী কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েক নারী সাবান দিয়ে হাত ধুইছেন। শেফালি বেগম নামের এক মহিলা বলেন, কেন্দ্রে আসার পর আনসার সদস্যরা বলেন, সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসেন। না হলে আঙুলের ছাপ মিলবে না। বুথে গিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। বুথে অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলছে না। শেফালি বেগম দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে যখন আঙুলের ছাপ দিতে গেলেন, তখন মিলছিল না। সব আঙুল দিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেননি তিনি। পরে আবার হাত ধোয়ার পরও আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা তার আঙুলে জেল মেখে দেন। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। হতাশ হয়ে দুপুর ১২টার দিকে ভোট না দিয়েই বেরিয়ে যান তিনি। একই কেন্দ্রে ফরিদা ইয়াসমিন ভোট দিতে এসেও একই ভোগান্তিতে পড়েন। তার মেয়ের জামাই এসএম মোজাম্মেল হক মামুন ১৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী। তিন দফা চেষ্টা করেও আঙুলের ছাপ মেলাতে না পেরে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পোলিং কর্মকর্তাকে নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোটটি নেওয়ার নির্দেশ দেন। পোলিং কর্মকর্তা তখন আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার আঙুলের ছাপও নিচ্ছিল না। এ কেন্দ্রে অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় তারা ভোট না দিয়েই চলে যান। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শামছুল হক আঙুলের ছাপ না মেলাসহ ইভিএমে ধীরগতির ভোটের কথা স্বীকার করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/509742