১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৮:৩৫

রাজনীতির অঙ্গন থেকে অপসংস্কৃতি দূর হোক

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||
১০ এপ্রিল ২০১৭,সোমবার, ০০:০০

প্রতিরোধ, ষড়যন্ত্র, দেশবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী, সংলাপ নয়, অপবাদ মরাগাঙ ইত্যাদি কথাগুলো আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল ব্যবহৃত। এসব কথা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না; বরং আমাদের রাজনীতিতে যে নেতিবাচক সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে তারই প্রতিফলন ও পরিপুষ্টি ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা, সৌজন্য বলে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। পক্ষান্তরে যদি সংলাপ, সমতা, সুবিচার, সুবচন, সমঝোতা শব্দগুলোর প্রচলন করা যেত তাহলে আজকে যে বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে, তার অবসান ঘটতে পারত। তাই এখন রাজনীতিকদের এই নেতিবাচক রাজনীতির অবসান ঘটানো উচিত। রাজনীতিতে নীতিপার্থক্য হতে পারে নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া-পদ্ধতির ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্য একান্ত জরুরি। ন্যূনতম জাতীয় ইস্যুতে যেমনÑ দেশরক্ষা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, বাকস্বাধীনতা ও নারী অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সবার একমত হওয়া কাম্য ছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছে। এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচলন করা আবশ্যক।
সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে যে ইতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তার প্রভাব দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর পড়বে। নেতিবাচক রাজনীতির ঘোরে এবং মারপ্যাঁচে জাতি এখন হালবিহীন জাহাজের মতো একই স্থানে দাঁড়িয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ দেশের সমস্যা সীমাহীন। হালে দেখা দিয়েছে উগ্রবাদী সমস্যা। এই সমস্যা ভয়ঙ্কর এবং এর পেছনে কার্যকারণ বহু। বিশেষ করে শেখার গলদ, বড় একটি কারণ। ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা যুবসমাজের কাছে নেই, ইসলামের সঠিক দৃষ্টিকোণ তাদের বোধগম্য নয়। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে দূর করে দেয়া হয়েছে। সামাজিক সুবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতির কোনো প্রতিকার দেশে অবর্তমান। এসব নিয়ে হতাশা এবং তার সমাধানের নিজস্ব পথ বেছে নিতেই জঙ্গিদের উদ্ভব এবং ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস।
জঙ্গিদের নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েছে বটে। কিন্তু এর সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে শক্তি দিয়ে দমন করা। কিন্তু এই পথ একটা পার্শ্বব্যবস্থা। এর বহুমাত্রিক সমাধান খুঁজতে হবে। এ জন্য রাজনীতিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ভেবে দেখতে হবে যুবকদের এই নেতিবাচক পথে চলার কারণ কী। তারপর সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, উগ্রবাদ এখন বিশ্বসমস্যা। একা একা নিজের ঘর সামলালেই এর সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন। তবে একই সাথে স্মরণ রাখতে হবে। এ জন্য পশ্চিমের দাওয়াই বিনা বিবেচনা গলাধঃকরণ করা যাবে না। এখন পর্যন্ত তাদের পথ কেবল শক্তি প্রয়োগ। কিন্তু সমাধানের পথ এককভাবে এটা নয়। নিজস্ব সামাজিক ও নৈতিক অবস্থান থেকে এর পথ বের করতে হবে। রাজনীতিকদের তথা দেশের শাসকবৃন্দকে এই সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
আর একটি শব্দ যুগল রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে চলে আসছে। তা হচ্ছে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাধারণত সরকার এমন কথা বলে থাকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। এই অভিযোগ উচ্চারণ করা হয় কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই। ঢালাওভাবে এত বড় অভিযোগ করা গর্হিত। প্রতিপক্ষের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করা মোটেই সমীচীন নয়। যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয়। অথচ জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েই তারা ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা তো দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করেননি। এসব বক্তব্য যারা উচ্চারণ করেন এতে তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং অসহিষ্ণুতা প্রমাণ করে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিক থেকে একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। “বাংলাদেশে ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) সম্মেলন নিয়ে বিএনপির প্রশ্ন তোলা ‘দেশবিরোধী’ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপির এই বক্তব্য শুধু দেশবিরোধী নয়, গণতন্ত্রবিরোধী।’’ সরকারের কোনো বক্তব্য বা কাজের সমালোচনা করা যদি দেশবিরোধী হয় তবে তো সরকারের কোনো সমালোচনাই করা যাবে না। এমন মন্তব্য করা তো অগণতান্ত্রিক। সরকারি দলের দায়িত্বশীল কোনো নেতার পক্ষে। এমন মন্তব্য করা অবশ্যই অনাকাক্সিত। এটা বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী।
দেশের এমন বহু সমস্যা রয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা বা সংলাপ একান্ত প্রয়োজন। দেশের প্রধান বিরোধী দল নানা বিষয়ে বহুবার সরকারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। অতীতেও দিয়েছে, বর্তমান সময়েও এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্বাচন সহায়ক একটি সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি আলোচনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তাতে ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিএনপি ও মিত্ররা অংশ নেয়নি। ফলে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়। কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার সমাধান তো হতে হবে। আর সমাধান তো এমনি এমনি হয়ে যাবে না। সমস্যার জড়িত পক্ষগুলো বসে আলোচনার মধ্য দিয়ে সবাইকে কিছু ছাড় দিয়ে তার সমাধানে পৌঁছতে হবে। পৃথিবীতে মহাযুদ্ধের পর বিবদমান পক্ষগুলো বসে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করেছে। বিভিন্ন দেশে নানা সমস্যা নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করে থাকে। কিন্তু আমরা তা করতে না পারায় সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। সংলাপের প্রস্তাব এলেই ‘না’ উচ্চারিত হয়।
শুধু নির্বাচন বললে, এর অর্থ স্পষ্ট হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচন বলতে বোঝায় হাজারও অনিয়ম, কারচুপি, ভোট ছিনতাই, হাঙ্গামা। গণতন্ত্র এখন সঙ্কটে রয়েছে। অতীতের মতো এখনো সংসদীয় গণতন্ত্র এখানের সমস্যার মুখোমুখি। সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষমভাবে টিকিক্ষােয় রাখার ক্ষেত্রে অপারগতা। যে কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ তার সাংবিধানিক ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না। বাস্তবতা ও কার্যকরতা বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্র অনেক বৈশিষ্ট্যই আমাদের এখানে অনুপস্থিত। স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরেই এ দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে এ যাত্রা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিশেষ রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র চর্চার সঙ্কট, রাজনীতিবিদদের অস্বাভাবিক আচরণ অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ক্ষমতার লোভ প্রভৃতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে বিভিন্ন সময়। এই কলুষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অমসৃণ যাত্রাকে সব সময়ই দেশের জনগণ দর্শক হিসেবে দেখেছে। এসব কারণেই বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতি পুনরুজ্জীবনের পর দুই যুগ কেটে গেলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি।
উপর্যুক্ত সমস্যাগুলোর পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণ অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এখানে আমাদের মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা করবে যে প্রতিষ্ঠানটি সেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট নয় দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। নির্বাচনের অনুকূল অবস্থা তথা আইনশৃঙ্খলা বিঘিœত না হওয়া। সরকারকেই নিশ্চিত করতে হয়, যাতে মানুষ অবাধে বিনা বাধায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলো কোনো রূপ অনিয়ম না করার মধ্যেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। অনিয়ম ও ভোট ছিনতাই করে যারা ক্ষমতায় যায় তারা জনমতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। নির্বাচনে হাজারো অনিয়ম করে থাকে। এর মাধ্যমেই যারা ক্ষমতায় যায় তারা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে। সব কিছু নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। প্রতিপক্ষের নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে। এর ফলে কোনো দলই নির্বাচনে পরাজয়কে মেনে নিতে চায় না। সত্যিকার অর্থে এ তো পরাজয় নয়, অনিয়ম করে হারিয়ে দেয়া। জনমতকে ভণ্ডুল করে দেয়া। এ ধরনের নির্বাচনের ফলে সুষ্ঠু যে নির্বাচনী সংস্কৃতি তার বিকাশ তো দূরের কথা, বরং এর পথকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতার চর্চা হবে গণতান্ত্রিক বিধিবিধানসাপেক্ষে। কোনো সিদ্ধান্ত হবে সংসদে জনপ্রতিনিধিদের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্কের মাধ্যমে। সঠিক সমাধানে পৌঁছার প্রক্রিয়া এটাই। ক্ষমতা চর্চার যে সংস্কৃতি তা এভাবেই নির্মিত হবে। এখন আর এ সংস্কৃতির প্রচলন নেই। তৈরি হয়েছে ভিন্ন পথ। পেশি শক্তিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। শক্তি যার কর্তৃত্ব তার। সমাজে এখন চলছে ক্ষমতাসীনদের শক্তির মাধ্যমে কর্তৃত্ব করার প্রতিযোগিতা। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলছে মহড়া। সুবিবেচনা, ন্যায়নীতি, মূল্যবোধ কোনো কিছুর এখন আর দাম নেই। জবাবদিহিতা ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অপরিহার্য বিষয়। এর মাধ্যমেই জনগণ জানতে পারে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ঠিকমতো চলছে কি না। জনগণ দেশের প্রকৃত মালিক। তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুসারেই দেশ চলছে কি না এটা জানার পদ্ধতি হচ্ছে সংসদের কার্যক্রম পরখ করা। সংসদ কিভাবে পরিচালিত হয়, সেটা নজরে আনা। এটা হতে পারে সংসদের অধিবেশনে দর্শক হিসেবে সরাসরি যোগ দেয়া। অথবা গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে অবহিত হওয়া। এই সংস্কৃতির চর্চা বহু দিন নেই। সংসদ আছে সদস্যরা আছে। যেহেতু সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। তাই কোনো জবাবদিহিতাও নেই।
সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করা যেমন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার তেমনি তা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু এখন সরকার এই অধিকার চর্চার সুযোগ দিচ্ছে না। নিজেরা এ সুযোগ নিচ্ছে বটে কিন্তু বিরোধী দল বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এ সুযোগ দিচ্ছে না। এই বৈষম্য চলছে দীর্ঘ দিন। রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের কথা বলতে অজ্ঞান। কিন্তু নিজেদের আচরণে তা নেই। বিশেষ করে দলগুলোর ভেতর কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই। দলে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্র নির্বাচনের কথা বলা হলেও তা প্রতিপালিত হয় না। দু-একটি দল ছাড়া আর কোনো দলেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই।
দেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে। তার পরিবর্তন একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এতটা নাজুক যে তারা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও একত্রে বসেন না। কোনো জাতীয় সঙ্কটকালে এমন কোনো জানালা নেই, যা দিয়ে তারা জরুরি মতবিনিময় করতে পারেন। এই লেখার প্রথমে কিছু নেতিবাচক শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রতিরোধ। এই শব্দটি রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার ব্যবহার হয়ে থাকে। দরজা বন্ধ করে দেয়ার মতোই এর অর্থ। কোনো ইস্যুতে বিরোধী দল যদি দাবি নিয়ে মাঠে নামতে চায়, তাহলে তাদের ঘর থেকে বের হতে না দেয়ার জন্য প্রতীকী অর্থে দরজা বন্ধ করে দেয়ার জন্য এই শব্দ প্রয়োগ হয়ে থাকে। পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া হয়। সরকার প্রতিপক্ষকে এখন রাজপথে আসা কিংবা সভা সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। জনগণ কাছে এসে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের যে অধিকার রয়েছে। সে অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
এই নেতিবাচক শব্দের প্রয়োগ এখন এভাবেই কার্যকর হচ্ছে। সরকারের এমন আচরণ এতটা বেড়েছে যে তা মৌলিক মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনপ্রতিনিধি বিরোধী দলের হলেই তাদের নানাভাবে প্রতিরোধ করা হচ্ছে দরজা বন্ধ করে দিয়ে। সম্প্রতি রাজশাহী সিলেট ও হবিগঞ্জের তিন মেয়রকে কোনো কারণ ব্যতিরেকেই বরখাস্ত করা হয়েছিল। সম্ভব তাদের একমাত্র অপরাধ তারা সরকারের পক্ষের লোক নন। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই তাদের হটিয়ে দেয়া হয়। তারা আইনি লড়াই করেন। ক্ষমতা ফিরে পেয়ে নিজ নিজ দফতরে আসন গ্রহণ করার মুহূর্তে আবার তাদের বরখাস্ত করা হয়। এখানে বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও আইনের শাসন মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে।
আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা জানাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারই যদি আইনের প্রতি ও বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে তবে দেশের মানুষ কোথায় গিয়ে শেষ আশ্রয় পাবে? শুধু আইন ও বিচার বিভাগকেও সরকার তোয়াক্কা করেনি; একই সাথে দেশের যারা প্রকৃত মালিক সেই জনগণের রায়কে সরকার বিবেচনায় নেয়নি। সরকার নিজেকে সব আইনের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করছে। এই যে নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তা আসলে সরকারকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারীতে পরিণত করছে। এটা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না। এটা বোঝা উচিত। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী বলেছেন মেয়রদের পদচ্যুত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুই জানেন না। মন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে এটাই বিশ্বাস করতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়েই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। তা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে যে সরকারের ভেতর সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এই বক্তব্যের পাশাপাশি মন্ত্রী মহোদয় যদি বলতেন তিন মেয়রকে পদচ্যুতির বিষয়টি সঠিক হয়নি। তাহলে আইন গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখানো হতো। সে যা-ই হোক, ্সরকার এর আগেও বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়র ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদচ্যুত ও কারাগারে পাঠিয়েছেন। খুলনা ও গাজীপুরের মেয়রদ্বয় এবং প্রায় চার শ’ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে পদচ্যুত করা হয়।
প্রচলিত নেতিবাচক রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে সুবচন সংলাপ সৌহার্দ্যরে রাজনীতি শুরু করা আর দেরি নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য এক কাতারে শামিল হতে হবে। যে অপসংস্কৃতি চলছে, তা অপসারণ করার জন্য উদ্যোগী হওয়া জরুরি।
ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, কথাগুলো বহুল প্রচলিত কথা। কথা বলার আগে দেখা উচিত যে এটা শুধু কথার কথা। নাকি আক্রমণ করার জন্য বলা। নাকি প্রতিপক্ষকে জনসমক্ষে হেয় করার উদ্দেশে বলা। এমন বক্তব্য যখন কোনো দায়িত্বশীল মহল থেকে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের সৃষ্টি করে। অহরহই কথাগুলো বলা হয়। যারা বলেন তারা হয়তো ভেবেও দেখেন না এই কথার তাৎপর্য কী দাঁড়ায়? সাথে সাথে এ প্রশ্ন তো সৃষ্টি হতে পারে। দেশের ভেতর যদি ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে তবে এ নিয়ে সরকারের দায়িত্বটা কী। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিপক্ষের প্রতি এই অপবাদ হামেশাই দেয়া হয়। অন্যান্য পক্ষ থেকেও এমন কথা উচ্চারণ করা হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/210890