৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ২:০৪

পাটশিল্পের মতোই ধ্বংসের পথে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প

হাজারীবাগের চামড়াশিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) রফতানি আদেশ বাতিল হবে। এ পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্পের মতোই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে। হাজারীবাগের চামড়াশিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে প্রায় ৫০ লাখ লোক বেকার হয়ে যাবে। ট্যানারিশিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্নের প্রতিবাদে আগামীকাল সোমবার মানববন্ধন করবে শ্রমিকরা।
জানা গেছে গতকাল হাজারিবাগের প্রায় সব ট্যানারিতে গ্যাস বিদ্যুৎ পানির লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এতে করে হাজারিবাগে আর কোনভাবেই চামড়া প্রসেস করা যাবে না। সাভারে নতুন সংযোগ পেলেই কেবল উৎপাদনে যেতে পারবে ট্যানারি মালিকরা। এর আগে সব ধরনের চামড়া রফতানি বন্ধ থাকবে। একই সাথে সব দেশের সাথে করা রফতানি আদেশও বাতিল হবে। কারণ কোনভাবেই আগামী তিন মাসের মধ্যে কোন ভাবেই চামড়া প্রসেস করতে পারবে না ট্যানারি মালিকরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সারা দেশে প্রায় চার শতাধিক ট্যানারি রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাজারিবাগের রয়েছে ২০৫ টি ট্যানারি। এর মধ্যে ১৫৫ টি ট্যানারি প্লট বরাদ্দ পেয়েছে সাভারে। বাকি ৫০ টি ট্যানারি এখনও কোন প্লট বরাদ্দ পায়নি। অথচ সব ট্যানারির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যারা প্লট পায়নি তারা কোথায় যাবে। আর কোন অপরাধে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো তা জানে না সংশ্লিষ্টরা। এসব ট্যানারি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। বেকার হয়ে গেলো এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরাও।
সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় উৎপাদন বন্ধ হ্ওয়ার কারণে আমাদের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) সংক্রান্ত ক্ষতি হবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। শাহীন আহমেদ বলেন, ২০০৩ সাল থেকে সাভারে চামড়াশিল্প নগরী স্থাপনের কাজ করছে বিসিক। সেখানে এখনও কাজ শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। সাভার চামড়াশিল্পের অঞ্চলের কাজ শেষ করতে আরও প্রায় ১ বছর সময় লাগবে। তবু হাজারীবাগ থেকে কারখানা সরাতে আমাদের চাপ দিয়ে আসছিল সরকার। অবশেষে আদালতে আদেশে সরকার আমাদের কথা আমলে না নিয়ে বিসিকের মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে সংযোগ বিচ্ছিন্নের রায় দেয় আদালত। এতে করে সংকটে পড়ে যায় দেশের চামড়াশিল্প।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি এ শিল্পের কথা বিবেচনা না করে তাহলে পাটশিল্পের মতই চামড়াশিল্পও হারিয়ে যাবে। বিসিকের অব্যবস্থাপনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে, হাজারীবাগের জমিতে ডিজাইন প্লান পাসের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে, যারা চামড়াশিল্প নগরীতে প্লট পাননি তাদের প্লট দিতে হবে, অবিলম্বে শিল্প নগরীতে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সব সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে, চামড়াশিল্প নগরীতে অসম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ও স্থাপনা বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সবার সামনে উপস্থাপন এবং শিগগির কাজ শেষ করতে হবে।
এছাড়া শিল্পোদ্যোক্তারা যাতে ঋণ সুবিধা পান- সে উদ্দেশ্যে শিল্প নগরীর প্লটের মালিকানা দলিল রেজিস্ট্রেশনের কাজও দ্রত শেষ করতে হবে।
শাহীন আহমেদ বলেন, হাজারীবাগের চামড়াশিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে প্রায় ৫০ লাখ লোক বেকার হবে। আমরা আদালতে রায় মেনে নিয়ে সরকারের কাছে চার মাস সময় চেয়ে ছিলাম। কিন্তু সরকার সে সময় না দিয়ে সব ধরনের লাইন সংযোগ করে দিয়েছে। এতে করে ট্যানারি মালিকদের পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। একইভাবে এর সাতে সংশ্লিষ্ট সব শ্রমিকরাই বেকার হয়ে পড়বে। সরকার যদি এতে কর্মসংস্থার এবং চামড়াশিল্পের ভবিষতের কথা বিবেচনায় না নেয় তাহলে এই ক্ষতির জন্য সরকারই দাযী থাকবে।
বিটিএ’র সাধারন সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের যে অর্ডারগুলো আছে, তার উৎপাদন আংশিক হয়েছে এবং আংশিক হয়নি। এখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যে পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে তা স্টক হয়ে যাবে। এছাড়া যেটা হয়নি সেটা আমরা সিফটিং করতে পারবো না। ফলে বায়াররা তাদের অর্ডার বাতিল করবেন। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন এবং কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি মিলিয়ে প্রায় ১১শ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।
হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে আমাদেরকে কোনো ধরণের নোটিশ করা হয়নি। আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু আমাদেরকে কিছুই জানানো হয়নি। আমাদের এখানে কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। যা এখন চুরি হয়ে যেতে পারে। একটা বাড়তি লাইন পর্যন্ত রাখা হয়নি। আমাদের টাকায় কেনা এখানকার ইলেকট্রিক মিটারটা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। এভাবে সবকিছু বন্ধ করে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে আগামী ১০ এপ্রিল হাজারীবাগে মানববন্ধন করবে ট্যানারি মালিকরা।
তিনি বলেন, সাভারের চামড়াশিল্পনগরীতে গ্যাসের লাইন দেওয়া হয়নি। কিছু ট্যানারি আছে যারা সাভারে এখনও প্লট পাইনি। এছাড়া সেখানে আমাদেরকে এখনও জমির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়নি। আমরা বলেছিলাম, চলতি মাসের ৬ তারিখের আগে যাতে সাভারের চামড়াশিল্পনগরীতে গ্যাস লাইন এবং জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। গ্যাস ছাড়া আমরা সেখানে গিয়ে কি করবো। আমরা তো উৎপাদনে যেতে পারবো না।
তিনি বলেন, আমাদের জমির রেজিস্ট্রেশন না দিলে হাজারীবাগ থেকে আমাদের মেশিনারিজগুলো স্থানান্তর করতে পারবো না। কেননা, আমাদের প্রত্যেকটা মেশিনারিজ ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া রয়েছে। তাই সাভারে গিয়ে যদি আমরা নতুন করে বন্ধক না দিতে পারি, তাহলে হাজারীবাগ থেকে মেশিনারিজ নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সে বিষয়ে বিসিক আমাদের কোনো কথাই শুনছে না। তাই সুযোগ থাকলে আমরা এখন বিসিকের বিরুদ্ধে মামলা করবো। এছাড়া সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই টাকা চাইবো।
প্রসঙ্গত, গতকাল শনিবার সকাল ৯ টার দিকে হাজারীবাগের ট্যানারিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ঢাকা ওয়াসা, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস এবং বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকো ও ডেসার কর্মকর্তারা নিজ নিজ সংস্থার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু করে।
উল্লেখ্য হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে একনেকে প্রকল্প পাস হয় ২০০৩ সালে। ১৩ বছর ধরে দফায় দফায় আল্টিমেটাম দিয়েছে সরকার। মালিকরাও বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু একটি ট্যানারিও পুরোপুরি সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়নি। সবশেষ এ মাসের মধ্যেই সব ট্যানারি সরিয়ে নিতে একমত হয় উভয়পক্ষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কোনো কারখানার অবকাঠামো তৈরি শেষ হয়নি। আবার কোনো কোেেনা কারখানা তৈরি কেবল শুরু হয়েছে। তাদের অভিযোগ আমরা এখনও প্লট বরাদ্দের কাগজপত্র বুঝে পাইনি। আর এ কারনেই ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে না অনেকেই। আর ব্যাংক ঋণ না পেলে কারখানা নির্মাণে এত টাকা কোথায় পাবে তারা। এছাড়া গ্যাস সংযোগও পাওয়া যাচ্ছে ন্ াতাহলে কিভাবে উৎপাদনে যাবে ব্যবসায়ীরা। কারখানার কাজ শেষ হতে আরও এক বছর সময় লাগবে। এ সময় সরকারকে দিতেই হবে। সময় না দিয়ে সরকার যদি আমাদের অযুক্তিভাবে চাপ প্রয়োগ করে তাহলে এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মালিকপক্ষ এখনও জমির বরাদ্দপত্র আর গ্যাস সংযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়। যদিও প্রকল্প পরিচালক বলছেন সব সেবা দিতে প্রস্তুত বিসিক।
তারা বলছেন,প্রতিদিন এখানে ১ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। সব কারখানা চালু হলে গ্যাসের চাহিদা হবে ৬ লাখ ঘনফুট। এ পরিমান গ্যাস দেয়ার ক্ষমতা নেই সরকারের।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রকল্পের সব কাজ শেষ। তারা ইচ্ছে করলে এখনই বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু তারা কেন এখানে কারখানা স্থনান্তর করছে তা আমার বুঝে আসছেনা। গ্যাস লাইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,এটি বিসিকের অধীনে নয়্ তারপরেও আমি জানি তারা যে শর্তে গ্যাস চাচ্ছে সব শর্ত মেনেই চাহিদা মাফিক গ্যাস দেয়া হচ্ছে। গ্যাসের কোন সংকট নেই।

http://www.dailysangram.com/post/279093-