খুলনা : সুন্দরবনের অভ্যন্তরে দিন দিন পলি জমে খালগুলো এভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে
৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ২:০১

সুন্দরবনের অর্ধশতাধিক নদী ও খাল বিপন্ন

বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নদী ও খালগুলো দিনদিন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় অধিকাংশ নদী ও খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। এখানকার জলাধারগুলোর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় একদিকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি নদী ও খালের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকাও বন্ধ হতে চলেছে।
জানা গেছে, সুন্দরবনের প্রাণ প্রায় অর্ধশতাধিক নদী ও খাল রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উপকূলীয় এলাকার এসব নদীকে জীবিকার অবলম্বন করে বেঁচে থাকা প্রায় ৫ লাখ মানুষ তাই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক নদী ও খালের নাম সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের মুখে মুখে ফিরলেও বাস্তবে অনেক নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
সুন্দরবন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এক সময়ের প্রমত্তা ভোলা নদী এখন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। এলাকাবাসী জানান, গত এক যুগেই ভরাট হয়ে গেছে প্রমত্তা এই নদীটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া এবং উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীটি ভরাট হয়ে চরে রূপ নিয়েছে, আর সেই চর এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। মৃতপ্রায় ভোলা নদীর দিকে তাকিয়ে রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা অনিলচন্দ্র বেপারি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'এই যে দেখা যাচ্ছে জমি। এসবের কিছুই ১০ বছর আগে ছিল না। এখানে অনেক বড় নদী ছিল। এই নদীতে আমরা মাছ ধরতাম। এই নদীই আমাদের তিন বেলা আহারের জোগান দিত। এখন আমাদের দুই বেলা ভাত জোগাড় করতেও অনেক কষ্ট হয়।'
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সুন্দরবনের বিলীনপ্রায় অর্ধশতাধিক নদী ও খালের মধ্যে রয়েছে- শরণখোলার ভোলা নদী, ধান সাগর, কলমতেজী, জিবধরা, নাংলী, আমুর বুনিয়া, বদ্যমারী, চাদপাই খাল, গোপের খাল, যশোরের টেকামুক্তেশ্বরী এবং খুলনার হামকুড়া, সালতা ও মধ্যবর্তী ভদ্রা ও হরিহর, সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, মরিচ্চাপ, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, যমুনা, গুতিয়াখালি ও সাপমারা নদী। এসব নদীতে এক সময় প্রবল জোয়ার ও স্রোত থাকলেও এখন তা মরা খালের মতো নিশ্চল। কপোতাক্ষের গোড়া চৌগাছার তাহিরপুর থেকে পাইকগাছার শিববাড়ি পর্যন্ত ১৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত নদী ও খালে চর পড়া এবং পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর বৃষ্টির মওসুমে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
সূত্র জানিয়েছে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুইটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইসগেট রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। এছাড়া ৫০টি গেটের তলদেশে পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। নদীগুলোর পানিপ্রবাহ হারানোর পেছনে এসব স্লুইসগেট অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সাতক্ষীরার ইছামতি নদীও এখন একইভাবে পলিতে ভরে গেছে। নদীটিতে বিশাল বিশাল চর জেগেছে। সীমান্তের অপর নদী সোনাইয়ের দশাও একইরকম। ভারতীয় ভূখ-ের নদ-নদীর সঙ্গে সংযুক্ত এই দুইটি নদী বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা ভাগ করেছে। চর পড়তে পড়তে এখানকার নদী তার অস্তিত্বব হারানোর ফলে বাংলাদেশের স্থলভূমিও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
দেখা গেছে, সুন্দরবনের নদী আড়পাঙাসিয়া, মাদার, মালঞ্চ ও চূনার মধ্যখানেও জেগে উঠছে বড় বড় চর। এর নিকটস্থ যমুনা নদী মারা গেছে তিনদশক আগেই। কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অন্যতম বেতনা নদীও তার নাব্যতা হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালে রূপ নিয়েছে। অনেক আগেই মরে যাওয়া মরিচ্চাপ নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার জন্য বারবার স্থানীয় জনগণ দাবি তুললেও সে আওয়াজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কানঅবধি পৌঁছায় না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুরের বাসিন্দা মিলন খান বলেন, 'নদী মরে যাওয়ায় আমরা খুবই কষ্টে আছি। মাছ ধরতে পারি না। বনের ভেতর ডাকাতদের ভয়ে ঢুকতে পারি না। বউ-পোলাপান নিয়ে বাঁচব কেমনে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না।' একই অবস্থা এখানকার লাখো মানুষের। সুন্দরবনের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন জনপদগুলোরও এখন মৃত্যু হতে চলেছে।
বনাঞ্চল রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি এনজিও প্রদীপন'র তথ্যে জানা যায়, ষাটের দশকে এই অঞ্চলে সাগরের লোনা পানি ঠেকানোর জন্য ৩৮টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেই পোল্ডারগুলোই কাল হয়ে এসেছে এই অঞ্চলের নদীগুলোর জন্য। ওইসব পোল্ডারের কারণেই শুকিয়ে গেছে এখানকার সব নদী। অভিযোগ রয়েছে, সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা পোল্ডারের কারণে উজানের পানিপ্রবাহ কমে গেছে।
এই অঞ্চল নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা প্রদীপনের বন বিষয়ক গবেষক ও এডভোকেসি অফিসার আহসান টিটু জানান, উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প ও অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণ নদী ধ্বংসের অন্যতম কারণ। সুন্দরবনের সঙ্গে এখানকার অর্ধশতাধিক নদীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নদী বিলীন হওয়া মানেই বিস্তীর্ণ সুন্দরবনই ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তাই সুন্দরবন রক্ষা করতে হলে আগে ফিরিয়ে আনতে হবে হারিয়ে যাওয়া ও বিলীনপ্রায় নদীগুলোর নাব্যতা। এজন্য সরকারের এখনই উদ্যোগ নেয়া দরকার।
দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর এমন করুণ দশা সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট পরিবেশ গবেষক প্রফেসর ড. সাইফুদ্দিন শাহ বলেন, অর্থের লোভে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব এলাকায় গড়ে তুলেছে বিশাল বিশাল চিংড়ি ঘের। ছোট বড় বাঁধ দিয়ে বছরে দুইবার স্বাদু ও লোনা পানি আনা-নেয়া করে ঘের মালিকরা। এর ফলে নদীগুলো তো ভরাট হচ্ছেই, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রাণিপ্রবাহও। তিনি বলেন, এসব অপরিকল্পিত চিংড়িঘের তুলে দিয়ে উজানের পানিপ্রবাহ পুনরায় চালুু করা গেলে সুন্দরবনের আশপাশের এবং অভ্যন্তর সব নদীই আবার প্রাণ ফিরে পাবে। রক্ষা পাবে সুন্দরবনও।

http://www.dailysangram.com/post/279140-