১৬ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ৭:২৮

বিশ্লেষকদের মত

সংকট ও সম্ভাবনা দুই-ই আছে

“‘বিষাক্ত ধোঁয়াচ্ছন্ন’ একটি পরিবেশে আফগান সরকারের পতন হচ্ছে। সামরিক বাহিনী কার্যত আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। কট্টর ও আগের চেয়ে ক্ষমতাবান জঙ্গিদের কারণে অনেকে আতঙ্কিত। যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদাররা সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে। এই জঘন্য জগাখিচুড়ি অবস্থার মধ্যে পড়েছে আফগান জনগণ।” গতকাল রবিবার সকালে কালের কণ্ঠকে এমনটিই বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রগ্রামের উপপরিচালক ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান।

এরপর দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, আফগানিস্তানে বড় ধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ পরাজয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ওই দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে গত ২০ বছরে যে অর্জন তা হঠাৎ মুছে গেল।

আফগানিস্তানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি রাখা ওই বিশ্লেষক কালের কণ্ঠকে বলেন, “আফগানিস্তানে ‘রিলেটিভ স্ট্যাবিলিটি’ বা ‘তুলনামূলক শান্তি-স্থিতিশীলতা’ ছিল গত কয়েক বছর। এটির এখন ব্যাঘাত ঘটবে বলেই আমার মনে হচ্ছে।” তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তান ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ায় সহিংস উগ্রবাদের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। আমরা এরই মধ্যে দেখেছি, বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তরুণ আফগানিস্তানে গেছে। তারা আফগানিস্তানে তালেবানের পক্ষে যুদ্ধ করতে চায়।’

অধ্যাপক লাইলুফার বলছেন, এই অঞ্চলে সহিংস উগ্রবাদের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। মধ্য এশিয়ায় ডিজিটাল উগ্রবাদীদের একটি গোষ্ঠী আছে। তাদের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ আছে। সুতরাং তালেবান এখন জোরালোভাবে এখান থেকে কর্মী নিয়োগ করবে।

আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের সম্ভাবনার কথাও বলছেন অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন। তাঁর মতে, ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তান এই চার দেশ মিলে নতুন একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক’ জোট আবির্ভূত হতে পারে। চীনের গণমাধ্যমে বারবার প্রচার করা হচ্ছে, চীনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তালেবান নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এই ছবিগুলো প্রচার করার মাধ্যমে চীনা সমাজে তালেবানের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা চলছে। চীনারা বুঝতে পারছেন, তালেবান আফগানিস্তানে বড় শক্তি হিসেবে সব সময় থাকবে। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের ইতিহাস মুছে গেল, তার জন্য আমি মনে করি না আমাদের ওরকমভাবে সেখানে কিছু করার আছে। সার্কের আওতায় সদস্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের বরং এই পরিস্থিতিতে নিজেদের দেশকে আগে সামলাতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাতে আফগানিস্তানের তালেবানের খপ্পরে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

আফগানিস্তান পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জিং বলে অভিহিত করলেও সেখানে সম্ভাবনাও দেখছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে দুই ধরনের চিন্তা করা যায়। একটি হলো বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে কাবুল দখলের মাধ্যমে যদি তালেবান ক্ষমতা দখল করে, তাহলে আফগানিস্তানে মানবিক সংকট, শরণার্থী বা বাস্তুচ্যুতি দেখা যেতে পারে। সংঘাতের মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন শেষ হলে সেখানে বিভাজিত সমাজ, সংঘাত—এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবার জন্যই চিন্তার কারণ। তিনি বলেন, একটি সম্ভাব্য নেতিবাচক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা অনেকেই করছে। সেটি একটি দিক। যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয় এবং সেখানে যদি সর্বদলীয় বা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকার গঠিত হয় এবং আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের ভূমিকাগুলো ইতিবাচকভাবে বাস্তবায়িত হলে নেতিবাচক শঙ্কাগুলো বাস্তবে না-ও হতে পারে।

সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে যুদ্ধবিরতি বা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা এবং আগামী দিন একটি নির্বাচনের চিন্তাও হতে পারে বলে মনে করেন এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘সেখানে যদি মানবাধিকার, নারীদের অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং সব গোষ্ঠীর মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা যে হিংস্রতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা করছি, সেটি হয়তো বাস্তবে না-ও হতে পারে। দুটি সম্ভাবনাই আছে।’

হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের ওপর আফগানিস্তান পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে অনেকে বেশ কিছু আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে তালেবান যদি সত্যিকারের দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানকে পরিচালনা করতে চায়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষমতায়ন, ব্র্যাকের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা, ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগী হওয়ার সম্ভাব্য সুযোগের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

আফগানিস্তানে পরিবর্তন আসার ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে সম্ভাব্য পরিবর্তন প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবির বলেন, তালেবান ক্ষমতায় এলে যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না, এমনটি মনে রাখার কারণ নেই। যারাই সরকার চালাক ভূ-রাজনীতি ও ভারসাম্যের বিষয়টি তাদের মাথায় রাখতে হয়। জীবনমান উন্নয়নে তাদের কাজ করতে হবে। সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই কাজ করতে হবে দেশটিকে। বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তানের উন্নয়নে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ভারতও সেখানে প্রচুর উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। খুব দ্রুত পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তাই ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা ঠিক হবে না।

আফগানিস্তান ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের জনগণের দুর্ভোগ আর দেখতে চায় না। বাংলাদেশ আশা করে, আফগানিস্তানের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।

আফগানিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকও তার কর্মীদের ফিরিয়ে আনছে। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, গণমাধ্যমের খবর এবং বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে আফগানিস্তান পরিস্থিতি জানছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অংশগ্রহণে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে। বাংলাদেশের নীতি হলো যেকোনো দেশে জনগণের আস্থায় থাকা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা। বাংলাদেশ তাতে অবিচল আছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/16/1063880