১৬ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ৭:২৫

‘স্লিপ’ বাণিজ্যে অস্থির খাতুনগঞ্জ ভোগ্যপণ্যের বাজার

লকডাউনে দেশের বৃহত্তর পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ডিও বাণিজ্যের পাশাপাশি স্লিপ বাণিজ্য অনেকটা কম ছিল। যার ফলে বাজার অনেকটা

স্বাভাবিক ছিল তখন। এমনকি গেল কোরবানির ঈদেও মসলা জাতীয় পণ্যের বাজার ছিল স্থিতিশীল। তবে সরকার লকডাউন তুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসেছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী। সেই আগের রূপে তারা ডিও বাণিজ্যের পাশাপাশি স্লিপ বাণিজ্যে ফিরে এসেছে। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে গুজব ছড়িয়ে তারা ‘স্লিপ’ নামে বিশেষ কাগজ ছড়িয়ে দিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

জানা যায়, গত শনিবার খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে মণপ্রতি চিনির দাম আগের চেয়ে ১১০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিমণে পাম অয়েলের দাম আগের সপ্তাহ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে হয় ২ হাজার ৭০০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম আগের চেয়ে ২০০ টাকা বেড়ে ৪৩০০ টাকা প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে।

মসুর ডাল প্রতিমণে ১৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মটর ডাল ৭০ থেকে ৮০ টাকা মণপ্রতি বেড়েছে। এভাবে বিশ্ববাজারে সামনে দাম বাড়ছে বলে তারা বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, লকডাউনের কারণে খাতুনগঞ্জে স্লিপ বাণিজ্য অনেকটা কম ছিল। এখন সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়ার ঘোষণায় এই ব্যবসা আবারো চাঙ্গা হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।

এই ব্যবসায়ীদের কথার সত্যতা মিলে খাতুনগঞ্জের নবী মার্কেট, জাফর মার্কেট, বাদশা মার্কেট, সোনামিয়া মার্কেট ও ইলিয়াস মার্কেটের সামনে গিয়ে। গত শনিবার সকালে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, শত শত ভ্রাম্যমাণ ব্রোকার স্লিপ ও ডিও বেচাকেনার জন্য ভিড় করছে। আগে থেকে এসব মার্কেটে থাকা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে হাজার হাজার ব্রোকারের আনাগোনা থাকতো। তবে গত বছরের লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এই ভিড় কমতে থাকে। এখন আবার ব্রোকারদের আনাগোনা বেড়ে গেছে সেখানে।

বাদশা মার্কেটের সামনে স্লিপের জন্য আসা আবুল কালাম নামে এক ব্রোকার এই প্রতিবেদককে বলেন, লকডাউনে দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা সরাসরি আমদানিকারক ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনতো। তাই সেসময় আমাদের ব্যবসা বলতে গেলে একবারেই ছিল না। এখন নতুন করে আবার শুরু হচ্ছে। আমাদের ব্যবসাও বাড়ছে।

জানা যায়, খাতুনগঞ্জে ডিও’র বিপরীতে স্লিপের ব্যবসা অনেকটা কাগুজে শেয়ারের মতো। পণ্য আমদানি করার পর প্রথম পর্যায়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পাইকারদের কাছে ডিও বিক্রি করে দিয়ে লাভের টাকা তুলে নেয়। আর এই পাইকাররা মধ্যস্বত্বভোগী ব্রোকারদের কাছে ওই ডিও ফের বিক্রি করে আরেক দফা লাভ করে। ডিওর মূল্য বেশি হলেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েও কেনা যায় বিশেষ স্লিপ। এভাবে স্লিপ হাতবদল হতে হতে পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর স্লিপে বেঁধে দেয়া সময়ে পণ্যটির দাম আগে থেকে নির্ধারণ করে দেয়া দামের কম থাকলে লোকসান হয়। আর বেশি থাকলে লাভবান হয় ব্রোকার।

খাতুনগঞ্জের ইলিয়াস মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমদানিকারক ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো তেল, ডাল, মসলাসহ কয়েকটি পণ্যের বিপরীতে বাজারে প্রচুর ডিও বিক্রি করেছে। আবার পাইকাররা সেই ডিও কিনে তা ব্রোকারদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এভাবে কয়েকহাত ঘুরে এই পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

মোহাম্মদ শাহজাহান নামে এক মসলা ব্যবসায়ী বলেন, আমদানিকারকরা অধিকাংশ সময় তাদের অর্ডারকৃত পণ্যের বিপরীতে ডিও বিক্রি করেন। এই ডিওধারীরা আবার নিজেদের কেনা ডিও’র বিপরীতে অতিরিক্ত স্লিপ বিক্রি করে টাকা তুলে নেন। এসব স্লিপ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য উত্তোলনের কথা থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রোকারদের লাভ হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলোর হাত বদল হতে থাকে।

এদিকে অতিলোভের কারণে অনেকে আবার ব্যাংক ঋণসহ উচ্চ সুদে টাকা দিয়ে স্লিপ কিনেন। অতিরিক্ত এসও প্রবাহের কারণে অনেক সময় পণ্যের দামও দ্রুত কমে যায়। টিকে থাকার প্রয়োজনে সেসময় কম দামে পণ্য বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেন তারা। এই অবস্থায় লোকসানের ধকলে অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাক্তাই খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী নেতা মানবজমিনকে বলেন, মূলত টিকে গ্রুপ, এস আলম, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা তাদের ইচ্ছামতো পণ্যের দাম উঠানামা করাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে বলার মতো কেউ নেই। আর খাতুনগঞ্জের কয়েকটি বড় ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান এই শিল্প গ্রুপগুলোর সঙ্গে মিলে বাজার অস্থির করছে। এদের মধ্যে এশিয়া ট্রেডিং, এমজি ট্রেডিং, জাহেদ ব্রাদার্স, মুক্তা স্টোর, অশোতোষ স্টোর, কাশেম ট্রেডিংসহ কয়েকটি মধ্য সারির ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
তিনি বলেন, সারা দেশের ভোগ্যপণ্যে প্রধান কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ। এখানে দাম বাড়লে সারা দেশেও পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রশাসনের উচিত ছিল এই বাজারকে ভালোভাবে তদারকি করা। কিন্তু তারা সেভাবে করে না। দেখা যায় শুধুমাত্র ঈদ কোরবানি আসলেই বাজার মনিটরিংয়ে লোকজন আসেন। বাকি সময় আর খোঁজ থাকে না।

তবে স্লিপ বাণিজ্যসহ খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্থিরতা নিয়ে জানতে চাইলে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মানবজমিনকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে ডাল, তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এখানে সিন্ডিকেটও স্লিপ বাণিজ্যসহ কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই।

এই বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক মানবজমিনকে বলেন, স্লিপ বাণিজ্যসহ কয়েকটি কারসাজি নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের টিম সেখানে অভিযানে যাবে। সবকিছু খোঁজখবর নিয়ে তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=288471&cat=3