১৪ আগস্ট ২০২১, শনিবার, ৪:২৭

নদীতে বিলীন কুড়িগ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি

মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই অনেকের; প্রকল্পের টাকা ব্যয়ে অনিয়মের অভিযোগ

নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে কুড়িগ্রাম জেলার কয়েকটি উপজেলার হাজার হাজার বাসিন্দা। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় হয়ে ছুটছেন তারা। গত ঈদুল আজহার পর থেকে শুধু রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা উপজেলার গতিয়াসামের একটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। যেখানে প্রায় ৪০০ বসত ঘর, ৫টি মসজিদ, একটি সরকারি বিদ্যালয়, খেলার মাঠ বিলীন হয়ে গেছে তিস্তা নদীর বুকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকার ভয়াল এই নদী ভাঙন ঠেকাতে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও স্থানীয় সরকারি আমলারা তা লুটেপুটে খাচ্ছে। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্যকেও তারা পাত্তা দিচ্ছে না। রাতের আঁধারে ১০০ ব্যাগ বালুর বস্তা নদীতে ফেলে হিসাবের খাতায় কয়েক হাজার ব্যাগের তথ্য উল্লেখ করা হচ্ছে। তাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৫৯৫ কোটি টাকা সঠিক নিয়মে ব্যয় করলে এই নদী ভাঙন কমানো সম্ভব হতে পারে।
গত সোমবার কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট, ফুলবাড়ি উপজেলা ও রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের নদী সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। নদী ভাঙনের ফলে ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের। স্থানীয়রা বলছেন, নদীভাঙনের ফলে তাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। যেভাবে যেখানে বালু ভর্তি জিও বস্তা ফেললে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে, সেখানে বস্তা ফেলছে না জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

গতিয়াসাম গ্রামের বাসিন্দা আজাহার আলী মণ্ডল বলেন, স্ত্রী, দুই ছেলে, তিন মেয়ে নিয়ে বছরের পর বছর তিনি এখানে বাসবাস করে আসছিলেন। এর আগে তার পূর্বপুরুষরাও বসবাস করে গেছেন। কিন্তু ঈদের কয়েক দিন আগে তিস্তার ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়ে যায় তার বসতভিটা। বসতভিটা ছাড়া বাড়িতে গাছগাছালি ছিল, উঠান ছিল, ছিল বড় পুকুর। তিস্তার ভাঙনে সবই নিমিষে শেষ হয়ে যায় আজহারের। এখন ভাগ্নের বাড়িতে কোনো রকম দোচালা ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি বলেন, প্রতি বছরই এখানে নদীভাঙনে বহু পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। ঈদের দিন আমরা নামাজ আদায় করতে পারিনি। প্রতিদিন কারো না কারো ঘরবাড়ি ভেঙে পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। পানির স্রোত এতটাই প্রবল যে, একটি বাড়ির সমান মাটির পুরো আস্তর ভেঙে পড়ে। তাই রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারে না কেউ। কখন নদীতে বিলীন হয়ে যাবে স্বপ্নের ঘরবাড়ি। পালাক্রমে পাহারা দেন গ্রামের মানুষ।
তিস্তা পাড়ের আরেক বাসিন্দা মো: আলম ফরাজী। নিতান্তই দিনমজুর একজন মানুষ। দিন এনে খাওয়া এই মানুষটির বিপদ যেন দূর হচ্ছেই না। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার বসতভিটা দুই দুইবার তিস্তায় বিলীন হয়েছে। এখন যেখানে ঘর করেছেন, সেখানেও হুমকির মুখে রয়েছেন।
নদীর দিকে দেখিয়ে মো: আলম ফরাজী বলেন, বাবুর বাজার এলাকায় ছিল তার বাড়ি। সেটি এখন নদীতে। দুই বার ভাঙার পর শুধু ঘর তোলার জন্য সামান্য জমি কিনেছি। নদী ভাঙতে ভাঙতে এতটা কাছে চলে এসেছে যে, এই...ঘরটাও মনে হয় ভেঙে যাবে। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়াররা আসেন না, আসলেও তাদের সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল।

ধরলা নদীর পাড়ের বাসিন্দাদেরও করুণ অবস্থা দেখা যায়। মোগলবাসা ইউনিয়নের সেনেরখামার গ্রাম সংলগ্ন ধরলা নদী ও কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট এলাকার বাসিন্দাদের আতঙ্ক বর্ষা মৌসুম। এ সময়ে বাঁধ ভেঙে কিংবা বাঁধের ওপর দিয়ে গ্রামে পানি ঢোকার আতঙ্ক থাকে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল আজি বলেন, প্লাবন থেকে এই এলাকাকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী একনেকে একটি প্রকল্প পাস করেন। প্রায় ১২ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে যে ম্যাপ তৈরি করে বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তা মানছেন না। তারা টাকা আত্মসাৎ করার জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের দলিলকৃত প্রায় ১৫০ একর জমি দখল করে বাঁধ দেয়ার পাঁয়তারা করছে।

এসব ব্যাপারে স্থানীয় কুড়িগ্রাম-২ আসনের সাংসদ মো: পনির উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভাঙনের চরম বিপদ থেকে কুড়িগ্রামবাসীকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী ৫৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। অথচ সেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বাসিন্দাদের কষ্ট শেষ হচ্ছে না। তার অভিযোগ, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী টেন্ডারের দরপত্র আহ্বান করলেও তার মনোনীত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ায় ধরলা নদীর বাঁধ রক্ষা প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। নদীর ভাঙনে ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি উপজেলায় তড়িৎ গতিতে কাজ করতে পাউবোর কর্মকর্তাদের বলেছি। কিন্তু তারা দেখছি, দেখবো বলে কিছুই করছে না। এমনকি পাউবোর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো তারা আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। বিষয়গুলো তিনি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত আকারে জানিয়েছেন। তাছাড়া স্থানীয় এক বাসিন্দা দুদকেও লিখিত অভিযোগ করেছেন।

কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম বলেন, এমপির লোকদের কাজ না দেয়ায় তারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। এমপির পিএস তার কাছে যে কাজ চেয়েছেন, তার কাছে এমন প্রমাণাদিও রয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালক সব যাচাই-বাছাই করেন, সব ঠিক থাকলে কাজ দেয়া হয়ে থাকে। এখানে এককভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। ফুলবাড়ির সোনাইগাজীসহ বেশ কয়েক জায়গায় জিও বস্তা ফেলা হয়েছে। মৌসুমে সিসি ব্লকও ফেলা হবে। টেন্ডারসহ যাবতীয় কাজে তিনি কোনো অনিয়ম করেননি বলে তার দাবি

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/601430/