১৩ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১:৫৪

চট্টগ্রামে মডার্না টিকা

নিবন্ধনেও পাননি বয়স্করা টোকেনে পেলেন তরুণরা

শেষ দিনে গাজীপুরে দীর্ঘ সারি

মডার্নার টিকা পেতে সপ্তাহ তিনেক আগে নিবন্ধন করেন চট্টগ্রাম নগরের নাসিরাবাদ আলফালাহ হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ মনজুর। চট্টগ্রাম পুলিশ হাসপাতাল কেন্দ্রের জন্য নিবন্ধিত এই জ্যেষ্ঠ নাগরিক এখনো টিকাদানের এসএমএস পাননি। গত ৭ আগস্ট গণটিকার দিন তিনি নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন টিকা নেওয়ার জন্য; কিন্তু মেলেনি। অথচ ওই কেন্দ্রে ৩৩ বছর বয়সী এক যুবক কাউন্সিলরের দেওয়া টোকেন নিয়ে গ্রহণ করেছেন মডার্নার টিকা।

শুধু মনজুর নন, নিবন্ধন করেও কয়েক লাখ মানুষ মডার্নার টিকা দিতে পারেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রগুলোতেও এই টিকার প্রথম ডোজ প্রদান বন্ধ রয়েছে। গত ১৩ জুলাই থেকে মডার্নার টিকা দেওয়া শুরু হলে এরই মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ নিবন্ধন করেছেন। অনেকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, গণটিকা শুরু হলে নিবন্ধনকৃতরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা নিতে পারবেন।

অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম নগরে ৪১টির মধ্যে বেশির ভাগ ওয়ার্ডে গণটিকার দিন মডার্নার প্রথম ডোজ দিতে পেরেছেন শুধু স্ব স্ব ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলরদের সরবরাহকৃত টোকেনপ্রাপ্তরা। সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে টোকেন দেওয়ার কারণে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষসহ অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। কাউন্সিলর ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ পরিচিতদের বেশির ভাগ মডার্নার প্রথম ডোজ পেয়েছেন।

নিবন্ধনকৃতদের মধ্যে কয়েকজন জানান, শুধু টোকেন দিয়েছে তা নয়, নগরের খুলশী এলাকায় গণটিকা থেকে পাচার করে বাসায় নিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে টিকা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

টোকেনের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গণটিকার চাহিদা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সে পরিমাণ টিকা ছিল না। ওই দিন ৯টা থেকে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার তিন-চার ঘণ্টা আগে হাজারো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা ওয়ার্ডের তিনটি কেন্দ্রের প্রতিটিতে ৩০০ করে মোট ৯০০ জনকে টিকা দিতে পারব। তাই তিন কেন্দ্রের সারির প্রথমে ছিলেন—এমন ৯০০ জনকে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। অন্যদের বলেছি—আবার গণটিকা শুরু হলে তাঁদের দেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে টোকেনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নিবন্ধনের কপি ছাড়া কাউকে টিকা দেওয়া হয়নি। তবে যাঁরা নিবন্ধন করতে পারেননি, তাঁদের আমাদের উদ্যোগে নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছি।’

বেশির ভাগ ওয়ার্ডে টোকেনের মাধ্যমে মডার্নার টিকা দেওয়া হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে জহরলাল হাজারী বলেন, ‘গণটিকার দিন ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৯০০ জন করে (ওয়ার্ডে তিন কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিটিতে ৩০০ জন করে) দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে গণটিকার প্রত্যাশী ছিলেন চার-পাঁচ হাজার জন করে। কিন্তু আমাদের বরাদ্দ আছে ৯০০ করে। টিকা সীমিত থাকায় শুনেছি কোনো কোনো ওয়ার্ডে বিশৃঙ্খলা এড়াতে টোকেন দিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের সবার নিবন্ধন ছিল।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ২৪ লাখ মানুষ করোনার টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ লোক টিকা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে মডার্নার টিকা নিয়েছেন প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার জন।’

মডার্নার টিকা ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আজকে (গতকাল) থেকে মডার্নার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী সোমবার নাগাদ দ্বিতীয় ডোজ শুরু হবে।’

শেষ দিনে গাজীপুরে দীর্ঘ সারি

নিচতলার অপেক্ষমাণ চেয়ারগুলো পরিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকে গিজগিজ করছে বিশাল হল রুম। বাইরের লাইন দীর্ঘ হতে হতে ঠেকেছে কমপক্ষে সিকি কিলোমিটার। সেখানেও মানুষের গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। গতকাল শেষ দিনে মডার্নার টিকা নিতে আসা মানুষের এমন ভিড় দেখা গেছে গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ অডিটরিয়াম টিকাকেন্দ্রে। শুধু এই কেন্দ্র নয়, টিকা নিতে আসা মানুষের এমন ভিড় ছিল নগরীর পাঁচ টিকাদান কেন্দ্রেই।

দুপুর ১২টার দিকে টিকা নিতে আসা নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসন সড়কের বাসিন্দা গার্মেন্ট শ্রমিক আনোয়ার হোসেন (৪২) বলেন, ‘গত মাসের ১২ তারিখে রেজিস্ট্রেশন করি। বুধবার রাতে টিকা গ্রহণের মেসেজ পাই। ভেবেছিলাম শনিবার টিকা নেব। পরে জানতে পারি আজই (গতকাল বৃহস্পতিবার) মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া শেষ হবে। তাই সকাল সকাল এসেছিলাম টিকা নিয়ে অফিস যাব ভেবে। কিন্তু এসে দেখি দীর্ঘ লাইন। এর পরও অপেক্ষা করছি।’

নগরীর সালনার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলতাব হোসেন জানান, তিনি রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন ১৫ দিন আগে। সকালে মেসেজ পেয়েই চলে এসেছেন। টিকাকেন্দ্রে এসে দেখেন, বাইরে শুধু মানুষ আর মানুষ। তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও গেটের ভেতর প্রবেশ করতে পারেননি।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পোড়াবাড়ী এলাকার রাহাতুল আমিন বলেন, ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি, আবার কড়া রোদ। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন টিকার জন্য। সবার আগ্রহ মডার্নার টিকা নিয়ে। তাই এমন ভিড়। অনেকে ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর ১টায়ও টিকা নিতে পারেননি।

স্বাস্থ্যকর্মী মো. আমজাদ হোসেন জানান, অনেকে আগে মেসেজ পেয়েও টিকা নেননি। ভেবেছিলেন পরে নেবেন। কিন্তু ১২ আগস্ট থেকে মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া শেষ জানার পর একসঙ্গে সবাই টিকা নিতে আসায় এত ভিড় হয়েছে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত বঙ্গতাজ অডিটরিয়াম টিকাকেন্দ্রে দুই হাজারের বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। এখনো বহু মানুষ টিকার জন্য লাইনে অপেক্ষা করছেন।

একজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১২ আগস্টের পর থেকে মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ বন্ধের ঘোষণা দিলে ১১ আগস্ট থেকে ভিড় দেখা দেয় টিকাকেন্দ্রে, গতকাল যা ছিল নজিরবিহীন। ভিড় সামলাতে তাঁদের হিমশিম খেতে হয়েছে।

গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান জানান, বঙ্গতাজ অডিটরিয়াম ছাড়াও নগরীর ধীরাশ্রমের রাবেয়া আনোয়ার নগর মাতৃসদন, টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল, কাশিমপুরের বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব কেপিজে মেমোরিয়াল হাসপাতাল ও টঙ্গীর মরকুন নগর মাতৃসদন—এই পাঁচটি কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়। অন্য দিনগুলোর চেয়ে গতকাল ভিড় অনেক বেশি ছিল।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/08/13/1062975