১২ আগস্ট ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:৩১

চার দেয়ালে শৈশব হারাচ্ছে শিশুরা

নিবিড়। পড়ছে রাজধানীর একটি স্বনামধন্য স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। গেল দেড় বছরে অনেকটাই বদলেছে সে। মেজাজটা হয়েছে খিটখিটে। এখন বেশির ভাগ সময়ই মজে থাকে মোবাইল ফোনে। ফোনসেট কেড়ে নিলেই কাঁদতে কাঁদতে জলে ভাসায় চোখ। নিবিড়ের

বাবা আফজাল হোসেন আক্ষেপের সুরেই বলছিলেন, ‘তার কী দোষ! স্কুল বন্ধ। বন্ধু কিংবা সহপাঠীদের চেহারাও ভুলতে বসেছে ছেলেটা। করোনার এই অতিমারিতে কোথাও যে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোব, সেটারও উপায় নেই। এই অস্থির পরিস্থিতি আর কত দিন থাকবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। ফলে এত দিনে সন্তানদের অবস্থা যে কী হবে, সেটা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছি।’

শুধু নিবিড়ের বাবাই নন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা করোনার এই জাঁতাকল থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন। করোনার কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দুর্বিষহ এই সময়টাও দেড় বছরের ঘর ছুঁতে চলল। কেউ কেউ এই সময়ে ইট-পাথরের চার দেয়ালেই বন্দি। কেউ ঘরের বারান্দা আবার কেউ অট্টালিকার ছাদে খুঁজে নিচ্ছে দুরন্তপনার ছোট্ট পৃথিবী।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ ও খেলাধুলায় মগ্ন থাকত শিক্ষার্থীরা। এতে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বেড়ে উঠত তারা, কিন্তু করোনার আগ্রাসনে, বিশেষ করে ঘরবন্দি শিশুশিক্ষার্থীরা এক দুর্বিষহ জীবন পার করছে।

রাজধানীসহ সারা দেশের স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাসের সুবাদে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার দিতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। এই সুযোগে অনলাইনে হরেক খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। পাল্টে গেছে তাদের জীবনছক। আগের চেয়ে অনেক বেশি চোখ রাখছে টিভির পর্দায়। স্কুল নেই, নেই পড়ালেখার চাপ—তাই অভিভাবকরাও তেমন কিছু বলতে পারছেন না। তবে অনেকেরই দেখা দিচ্ছে চোখের নানা সমস্যা। আচরণও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে অভিভাবকদের।

জানা যায়, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গেল বছরের মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এমনকি কোনো পাবলিক পরীক্ষা, বার্ষিক পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হয়নি। একাধিকবার স্কুল খোলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাতে সফলতা আসেনি। অনলাইনে ক্লাস চললেও তাতে ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী যুক্ত হতে পারছে না। তবে শিক্ষার্থীদের ঠিকই পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা হচ্ছে। এতে বড় ধরনের শিখন ঘাটতিতে পড়েছে শিশুশিক্ষার্থীরা।

শিশুদের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে গত বছর ইউনিসেফ একটি গবেষণার ফল প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের তিনজনে একজন, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু এখন আর অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। করোনার কারণে শিশু অপুষ্টির হারও বাড়ছে। পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের ওপর নির্যাতন-সহিংসতায় দুর্ব্যবহারও বেড়েছে।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই শিশু। ১৮ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স তাদেরই শিশু ধরা হয়। সেই হিসাবে রাজধানীসহ সারা দেশে সাড়ে ছয় কোটির ওপর শিশু রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা প্রসারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী, এর মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘক্ষণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করলে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। শিশুরা মোবাইল অনেকক্ষণ ব্যবহার করলে তাদের স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। রেডিয়েশনের প্রভাবে একটা শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। অবশ্য এ ক্ষতিগুলো খুব সহজে বোঝা যায় না, লম্বা সময় পর ধীরে ধীরে বোঝা যায়। পাশাপাশি মোটা হয়ে যাচ্ছে অনেক শিশু।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার এই দীর্ঘ সময়ে শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, আড্ডা, গল্পও করতে পারছে না। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় দিনের পর দিন শিশুদের ঘরে আটকে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই শিশুদের বিনোদন দিতে সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া-ঘুম সবই চলছে। টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইল ফোনের ইউটিউবে চলে ভার্চুয়াল জগতে দৌড়ঝাঁপ। অনলাইনে ক্লাস চলায় শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে চলে এসেছে মুঠোফোন। পড়াশোনার থেকে বেশি চলে গেম বা ইউটিউবে সময় কাটানো। সারা দিন তারা একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুই চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ বা টিভির পর্দায়। বই পড়ারও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিশুরা।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘শিশুরা ঘরে থাকতে থাকতে মেজাজ খিটখিটে, মাথা ব্যথা, মোটা হয়ে যাওয়া, চোখের সমস্যা, ইন্টারেকশন কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। শিশুদের জন্য দরকার স্কুলে যাওয়া, মাঠে গিয়ে খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করা। এতে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ হয়, কিন্তু সেটা তো এখন হয়তো আমরা পারব না। তাই অভিভাবকদেরই উচিত হবে শিশুদের সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে ঘরের মধ্যেই খেলাধুলা করা, গল্প করা। তবে মোবাইল ফোন-টিভি থেকে যতটা সম্ভব শিশুদের দূরে রাখতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/12/1062638