১২ আগস্ট ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:২৮

বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুট

১৩৬ কোটি টাকা খরচ তবুও চলবে না ফেরি

সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন

জামালপুরের বাহাদুরাবাদ থেকে গাইবান্ধার বালাসী পর্যন্ত ফেরি রুট খনন এবং ঘাটের অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ইতোমধ্যে এসব কাজে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতুর বিকল্প পথ তৈরি করা হবে-এমন যুক্তি দেখিয়ে ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প দুই দফায় সংশোধনের মাধ্যমে টাকার অঙ্ক ও মেয়াদ বাড়ানো হয়।

গত জুনে ১৪৫ কোটি টাকার এ প্রকল্প শেষ হয়েছে। এমন সময়ে বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটটি ফেরি চলাচলের উপযোগী নয় বলে প্রতিবেদন দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ গঠিত একটি কারিগরি কমিটি। এছাড়া দুই দফায় ট্রায়াল রান করতে গিয়ে নাব্য সংকটে দুবারই আটকে যায় বিআইডব্লিউটিসির খালি ফেরি। এ কারণে বারবার উদ্যোগ নিয়েও এ রুটে ফেরি চালু করতে পারছে না নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনে প্রকল্পের বিভিন্ন দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ নৌরুটটি ২৬ কিলোমিটার দূরত্ব থাকায় বর্ষা মৌসুমে পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগবে, যা লাভজনক নয়। গাড়ির চালক বা মালিকরাও এ রুট ব্যবহারে আগ্রহী হবেন না। এছাড়া স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পের স্থান নিরূপণ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করায় নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দুই প্রান্তের ঘাট অন্যত্র স্থানান্তর ও ফেরিঘাটের জন্য তৈরি করা অবকাঠামো অন্য কাজে ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের আওতায় করা কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কারিগরি কমিটি।

বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোর সঙ্গে জামালপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের দূরত্ব ১০০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার কমিয়ে আনার যুক্তি দেখিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু ভুল স্থানে ফেরিঘাট নির্মাণ করায় ওই লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। এ কারণে প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হওয়া ১৩৬ কোটি টাকাই গচ্চা গেল। এর সঙ্গে দুই সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময় ও শ্রম নষ্ট হলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা অন্তত একটি ফেরি ওই রুটে চালু করার চেষ্টা করছি। সেটি স্থায়ী না হলে সেখানে বিকল্প হিসাবে লঞ্চ ও স্পিডবোট চালু করব। এছাড়া কারিগরি কমিটি দুটি বিকল্প যে প্রস্তাবনা দিয়েছে সেগুলো বিবেচনা করা হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) তৈরি না করতে অধীনস্থ সব সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, ‘বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাটসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ ফেরি রুট তৈরি করা হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে ডিপিপিতে বলা হয়, এ রুটে ফেরি চালু হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপ কমবে এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহণে স্থানভেদে ১০০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার কমে যাবে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। ওই সময়ে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প দুবার সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২ লাখ টাকা এবং মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ, পার্কিং ইয়ার্ড, ফেরিঘাট, ইন্টারনাল রোড ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ড্রেজিং করা হয় ফেরি রুট।

এ রুটে ফেরি চালুর বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, যমুনা নদীর চরিত্র ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হওয়ায় বছরে কয়েকবার রুট পরিবর্তন করে। ওই রুটে প্রচুর পলি পড়ে। পলি পড়ার হার এতই বেশি যে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রুট পরিবর্তন হয়ে যায়, যা ফেরির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ফেরিগুলোর যে অবস্থা তাতে ৪-৫ ঘণ্টা টানা চলা সম্ভব নয়। ফেরিঘাটে অপেক্ষা, ফেরিতে ওঠানামা ও পারাপারে ৪-৫ ঘণ্টা সময় নষ্ট করে কোনো গাড়ি ফেরিতে উঠবে না।

যে কারণে চালু হচ্ছে না : জানা যায়, বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। এটি যা শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের দ্বিগুণের বেশি দূরত্ব। এছাড়া গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাটের সংযোগ রাস্তা খুবই সরু। ওই রাস্তার কোথাও ১২ ফুট আবার কোথাও ১৮ ফুট প্রশস্ত। ফলে পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলাচল করতে পারবে না। এছাড়া ওই রুটে দুই দফায় গাড়ি ছাড়াই খালি ফেরি নিয়ে ট্রায়াল রান দেয় বিআইডব্লিউটিসি। দুই দফায় নাব্য সংকটে ফেরি আটকে যায়। বিআইডব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদীতে পানির প্রবাহ বেশি থাকা অবস্থায় ফেরি চলাচল করতে পারছে না। শুষ্ক মৌসুমে ফেরি চলতেই পারবে না। এ কারণে ওই রুটে ফেরি পাঠানো হচ্ছে না।

কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন : প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে এসে বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি সার্ভিসের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করে বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিতে বিআইডব্লিউটিসির তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক এইচএম আশিকুজ্জামানসহ পাঁচজনকে সদস্য করা হয়। কমিটির সদস্যরা এপ্রিল ও মেতে সরেজমিন পরিদর্শন করে সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

প্রকল্পের বিভিন্ন দুর্বল দিক উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কেবল বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করায় নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুপাড়ে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। প্রকল্প শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সড়ক বিভাগ রাস্তা নির্মাণকাজ শুরু করেনি।

ড্রেজিংয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে, ওই রুটে যে পরিমাণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক কম ধরা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হলেও নৌপথের চ্যানেল পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রতিবছরই এ চ্যানেল দু-একবার পরিবর্তন হয়। এছাড়া ২৬ কিলোমিটার পথ ড্রেজিংয়ে যে পরিমাণ খরচ হবে বা বাজেটে রাখা খুবই দুরূহ। এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার সময়ে বাহাদুরাবাদ অংশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করা হয়নি এবং কম দূরত্বের নৌপথ চিহ্নিত করা হয়নি।

যে প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয় এ প্রকল্প : জানা গেছে, প্রকল্প নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফেরি রুটের উভয় প্রান্তের জনপ্রতিনিধিদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিআইডব্লিউটিএ-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিআইডব্লিউটিএ-এর প্রশাসনিক সংক্রান্ত এক সভায় এ রুটে ফেরিঘাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন নৌমন্ত্রী, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরেজমিন এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নিয়ে ফেরি চালুর বিষয়ে ঐকমত্য হন। সে আলোকে ২০১৪ সালে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর কোনো কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হলে উত্তরবঙ্গের মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। সেই কথা চিন্তা করে এবং জামালপুরের সঙ্গে উত্তরবঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প নেওয়ার আগে সার্ভে রিপোর্টে পজিটিভ মতামত এসেছিল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/452987/