১২ আগস্ট ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:২৬

ব্যাংকের মুনাফা দিয়ে সংসার চলছে না আমানতকারীদের

মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে কমে আসছে সঞ্চয়ের পরিমাণ। ব্যাংকের মুনাফার হার তলানিতে ঠেকেছে। ব্যাংকের মুনাফা দিয়ে সংসার চালাতে পারছে না আমানতকারীরা। জুনে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ওই মাসে ব্যাংকগুলোতে সুদহার ছিল ১ থেকে ৬ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের সুদহারের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকে তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদী আমানতের সুদহার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না।

এদিকে আমানতের সুদের হার স্বাভাবিক রাখতে বাজার থেকে তারল্য তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সোমবার থেকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’-এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথমদিন ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ নিলামের মাধ্যমে বাজারের অতিরিক্ত তারল্য থেকে ২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি এ বিলের বার্ষিক সুদ হবে এক শতাংশের কম। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশে ব্যাংক বিল বিক্রি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থাটি। সোমবার প্রথম দিন এক হাজার ৫০৫ কোটি টাকার ৭ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ বিল ও ১১০০ কোটি টাকার ১৪ দিন মেয়াদের বাংলাদেশ ব্যাংক বিল নিলামে কিনে নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ৭ দিন মেয়াদি বিলের সুদহার শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং ১৪দিন মেয়াদের বিলের সুদহার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। নিলামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশে নিবাসী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিড দাখিল করতে পারলেও ব্যাংকগুলোই এ নিলামে অংশ নেয় বেশি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার মধ্যে ব্যাংকগুলোও টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় আমানতের সুদের হার কমেছে। তারা জানান, কয়েক বছর আগেও ব্যাংকে মেয়াদী আমানত রেখে ৯ থেকে ১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। এখন ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর অলস অর্থ পড়ে আছে। হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া ৫-৬ শতাংশ সুদ দিতে পারছে না কোনও ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো তিন মাসের কমে স্থায়ী আমানত জমা নেয় না। মার্চের শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ আমানত ছিল, তার ৪৫ শতাংশই ছিল স্থায়ী আমানত। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ছিল এক-দুই বছর মেয়াদী। এসব আমানতে এখন মাত্র কয়েকটি ব্যাংক ৬ শতাংশ বা এর বেশি সুদ দিতে পারছে।

বাজারে তারল্য বাড়াতে গতবছর সিআরআর কমানোসহ বিভিন্ন নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এসব কারণেও ব্যাংকগুলো আমানত নিতে অনীহা দেখাচ্ছে।

মূলত করোনাসহ বিভিন্ন কারণে আশানুরূপ ঋণ না বাড়ায় জুন শেষে ব্যাংক খাতে দুই লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এখন আমানত বেড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকের বাইরে সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে মানুষ বেশি আগ্রহী হলেও এখানে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। সঞ্চয়পত্রের জন্য টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মে পর্যন্ত এ খাতে বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি'র সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন জানান, ব্যাংকের চালিকাশক্তি আমানত। আমানতকারীদের আয় কমে গেলে ব্যাংক থেকে আমানত কমবে। হয়তো ব্যাংকগুলোর হাতে ভালো বিকল্পও নেই। আমানতকারীদের না ঠকিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমানো উচিত।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ঋণ চাহিদা ব্যাপক কমেছে। জুন শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। আমানতের সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতে দায়-সম্পদের ভারসাম্যহীনতা রোধে তিন মাস ও তদূর্ধ্ব মেয়াদী আমানতের সুদহার নির্ধারণে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদী আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্যৎতহবিল, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনও মেয়াদী আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হার অপেক্ষা কোনোভাবেই কম নির্ধারণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করতেও বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদহার কমছে। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংকের মেয়াদী আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে।

ক্ষুদ্র আমানতকারীদের একটি অংশ জীবিকা নির্বাহে আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মেয়াদী আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হলে আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এতে তারা ব্যাংকে টাকা না রেখে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে বসেন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক মুনাফার হার নির্ধারণ করে দিয়েছে।

https://dailysangram.com/post/461398