ফাইল ছবি
৮ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১২:৪৩

রেলপথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ট্যাম্পিং মেশিন

ছয়টির চারটিই বিকল

ট্যাম্পিং মেশিন প্রয়োজন ৩০টি, আছে ৬টি; যার মধ্যে ৪টি নষ্ট

বিশ্বের যে কোনো দেশের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে যে জিনসটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘ট্যাম্পিং মেশিন’। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ট্র্যাক কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর ৮৫ শতাংশই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া রেলব্রিজের ৭০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্তু দীর্ঘ এ রেললাইন ও ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ট্যাম্পিং মেশিনই নেই রেলে। বিদ্যমান রেলপথ সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্য ৩০টি ট্যাম্পিং মেশিন প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র ৬টি। এর মধ্যে ৪টি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সচল থাকা দুটি মেশিন আবার সকাল-বিকাল নষ্ট হয়। ট্যাম্পিং মেশিন দেখতে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো। এটি লাইনের ওপর দিয়ে চলার সময় ট্র্যাকের ত্রুটি-বিচ্যুতি, বিভিন্ন পয়েন্ট ও ক্রসিংয়ের কারিগরি ত্রুটির পাশাপাশি লাইনে পাথরও পরিষ্কার করতে সক্ষম। এই মেশিন দিয়ে লাইনের লেভেল ও অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা হয়।

এদিকে ট্যাম্পিং মেশিন না থাকায় এখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছু শ্রমিক কাজ করছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এ কাজের জন্য লোকবল খুবই কম রয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, পুরো রেলেই কংক্রিটের স্লিপার। এ ধরনের স্লিপার সমন্বয়ে তৈরি রেললাইন ট্যাম্পিং মেশিন ছাড়া মেরামত-সংস্কার করা সম্ভব নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্যাম্পিং মেশিন ছাড়া লাইন ঠিক রাখতে গিয়ে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুতসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। ট্রেন, যাত্রী-সাধারণের প্রাণহানিসহ লাইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে জরাজীর্ণ, সংস্কারবিহীন ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের তথ্যউপাত্ত। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৯৫ শতাংশ লাইনচ্যুত ও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের কারণে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে লাইন সংস্কার-মেরামতের ক্ষেত্রে যথাযথ পাথর দেওয়ার জন্য খালাসি, পয়েন্টম্যান, কি-ম্যান কিংবা মেইড-স্বল্পতা প্রায় তিন যুগের। ফলে রেলপথ সংস্কার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতহীন হয়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলে ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়। নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ২ লাখ হাজার কোটি টাকায় ৩৪টি উন্নয়ন প্রকল্প রেলে চলমান রয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। যেখানে ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয়ে আলাদা করে প্রকল্প নেওয়া হয়নি। রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, লকডাউনে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারের উপযুক্ত সময়। কিন্তু লোকবল বিশেষ করে ট্যাম্পিং মেশিন পর্যাপ্ত না থাকায় লাইন সংস্কার করা যাচ্ছে না। ট্যাম্পিং মেশিন থাকলে খুব সহজেই লাইন সংস্কার করা যেত। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে শ্রমিক দিয়ে লাইন মেরামত করা হলে তা যথাযথ হয় না।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালের এপ্রিলে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে একটি ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয় করা হয়। ০৮-১৬ গ মডেলের এ ট্যাম্পিং মেশিনটি অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়। দেশে সর্ব প্রথম ব্রডগেজের ট্যাম্পিং মেশিন এটি। গুরুত্বপূর্ণ এ মেশিন দিয়ে রেল লাইনের লেভেল, অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করাসহ পাথর সমন্বয়ে স্লিপার যথাযথ মজবুত রাখা হয়। এই মেশিন ঘণ্টায় ৬৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার স্পিডে চলে। এক কিলোমিটার রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও জরাজীর্ণ জায়গা চিহ্নিত করতে এ মেশিনগুলোর সময় লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন। এখনো সনাতনী পদ্ধতিতেই চলছে কাজ। সম্প্রতি পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে স্বল্প পরিসরে ট্যাম্পিং মেশিনের ব্যবহার শুরু হলেও সেগুলো চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। মেরামতের জন্য নেই ওয়ার্কশপ।

বর্তমানে সনাতনী পদ্ধতিতে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। যখন কাঠের স্লিপার ছিল তখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করা যেত। এখন রেলে কংক্রিটের স্লিপার। আধুনিক হয়েছে- কিন্তু আধুনিক সময়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে লাইনের ত্রুটি-অসঙ্গতি কর্মীদের চোখে পড়ে না। এতে ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রেলে গত ৫ বছরে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগের জন্য দায়ী রেলপথ ও রেলসেতুর রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া। ২০১৯ সালের ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় দুর্ঘটনায় পড়ে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস। ট্রেনটির পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। সেতু ভেঙে লাইনচ্যুত একটি বগি পানিতে পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত ও অন্তত ৬৪ জন আহত হন। রেলওয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে এ দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে রেলপথ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়াকে দায়ী করে বলা হয়, ‘দায়িত্বপ্রাপ্তরা রেলপথটি সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে মোট ৪টি ট্রেন দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত রিপোর্টে প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে জরাজীর্ণ রেলপথকে।

জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান অতিরিক্ত প্রকৌশলী-পথ মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে ট্যাম্পিং মেশিনের বিকল্প নেই। এই মেশিন দিয়ে জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার করা খুবই সহজ। বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলে ৪পি ট্যাম্পিং মেশিন রয়েছে। যার মধ্যে দুটি নষ্ট। বাকি দুটি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, অত্যাধুনিক এসব মেশিনের যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে সহজে পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করতে হয়। ততদিনে আরও যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এখন লাইন খুব একটা সংস্কার করা যায় না। তাই আরও ট্যাম্পিং মেশিন প্রয়োজন। পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান ট্র্যাক সাপ্লাই অফিসার রফিকুল ইসলাম জানান, যে দুটি মেশিন সচল রয়েছে-সেগুলো চালানোর দক্ষ কোনো শ্রমিক নেই। এসব মেশিন ক্রয়ের সঙ্গে দক্ষ লোক তথা প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগও জরুরি। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান অতিরিক্ত প্রকৌশলী আসরাদুল হক বলেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলে মোট দুটি ট্যাম্পিং মেশিন রয়েছে। বর্তমানে একটি নষ্ট। আরেকটির অবস্থা ভাল না। প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া এসব মেশিন চালাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকবল অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত ট্যাম্পিং মেশিন থাকলে চলমান রেলপথ মেরামত ও সংস্কার করতে খুবই সহজ। আমরা আরেকটি ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয় করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি।

রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী জানান, রেলপথ মেরামত ও সংস্কার কাজে নিয়োজিত লোকবল স্বল্পতা চরমে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়ার্কস ম্যানুয়াল অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটার রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ দশমিক শূন্য ৮ জন কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে কিলোমিটার প্রতি কাজ করছেন দশমিক ৭৫ জন কর্মী।

বেশ কয়েকজন রেলওয়ে প্রকৌশলী জানান, ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম করা যায় না। বিশ্বব্যাপী ট্যাম্পিং মেশিনের নির্ধারিত মূল্য রয়েছে। ফলে রেলের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয়ে আগ্রহ দেখায় না। অধিকাংশ কর্মকর্তাই নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণে ব্যস্ত।

সনাতনী পদ্ধতিতে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দুরবস্থার কথা একাধিকবার উঠে এসেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পর্যবেক্ষণে। এ বিষয়ে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা যুগান্তরকে জানান, ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয় জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ১টি ট্রাম্পিং মেশিন কিনতে অনেকদূর এগিয়েছি। চলমান বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় ৫-৬টি মেশিন ক্রয় করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বের সব দেশেই ট্যাম্পিং মেশিন কিংবা এ ধরনের অত্যাধুনিক মেশিন দিয়ে লাইন মেরামত করা হচ্ছে। এদিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে থাকতে চাই না। এ বিষয়ে রেলপথম২ন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমরা রেলে থাকা সব মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ করে ফেলছি। এছাড়া নতুন করে যেসব লাইন তৈরি করা হচ্ছে তা সবই ডুয়েলগেজ ও ডাবল ডুয়েলগেজ। এসব লাইন রক্ষণাবেক্ষণে অত্যাধুনিক মেশিন ক্রয় করতে হবে। আমরা অন্তত আরও ১০টি ট্যাম্পিং মেশিন ক্রয় করব। এজন্য ইতোমধ্যে প্রকল্প হাতে নিয়েছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/451477/