৮ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১২:৩৯

প্যান্ডোরার বাক্স খুলছে : পরীমনিরা বেরিয়ে আসছে : কিন্তু নেপথ্য প্রভুরা কোথায়?

ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে Pandora’s Box. অর্থাৎ প্যান্ডোরার বাক্স। এই বাক্সটি সহজে খুলতে নাই। খুললে পূতিগন্ধময় আবর্জনা বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে সাপ, ব্যাঙ, বিচ্ছু ইত্যাদি বিষধর প্রাণী। বাংলাদেশের সমাজ দেহও তেমনি একটি প্যান্ডোরার বাক্সে পরিণত হয়েছে। এই বাক্সটির মুখ সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয় নাই। যৎকিঞ্চিৎ উন্মোচিত হয়েছে মাত্র। আর তার ফলেই দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। বেরিয়ে আসছে পরীমনি, ঈশিতা, মৌ, পিয়াসা হেলেনা প্রমুখ সমাজঘাতী প্রাণী। প্রতিদিনই প্রিন্ট মিডিয়ায় এদের কারও না কারও কুৎসিত কেচ্ছা-কাহিনী ছাপা হচ্ছে। আলাদা আলাদাভাবে এদের নাম নিয়ে আলোচনা করবো না। কিন্তু ভিকারুন্নেসা স্কুল এবং কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন্নাহারের নাম নিতেই হয়। আপনার-আমার অনেকের কন্যাসন্তান ঐ ঐতিহ্যবাহী স্কুল এবং কলেজে পড়েছে বা পড়ছে। আমার দুই মেয়ে ভিকারুন্নেসা থেকে ম্যাট্রিক এবং আইএ পাস করেছে। একবার ভাবুন তো, তখনকার প্রিন্সিপাল হামিদা আলী এবং এখনকার প্রিন্সিপাল কামরুন্নাহারকে। একজন প্রিন্সিপালের মুখ থেকে কি এমন অশ্লীল, নোংরা এবং কদর্য গালিগালাজ উচ্চারিত হতে পারে? একটি বাংলা দৈনিক কামরুন্নাহারের ফোনালাপ সম্পূর্ণটাই ছাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও কয়েকটি জায়গা ডট ডট ডট (.......) করে ছেপেছে। ফোনালাপটি ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে ঐসব ডট ডট ডট (........) পূরণ করা হয়েছে। কত অশ্রাব্য ও নোংরা খিস্তি খেউর! বস্তি অথবা নিষিদ্ধ পল্লীতে এসব খিস্তি খেউর শোনা যায়। আজ ৮ আগস্ট। ১২ দিন হয়ে গেল, কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হলেও সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হয়নি। কি ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটা সরকার ভালো জানে। কিন্তু কামরুন্নাহার আর ঐ পদে থাকতে পারেন না।

অন্যদের কথা কি বলব? এদের কেউ কেউ নাকি মডেল। মডেল হলেই কি ১১টি বিয়ে করতে হবে? ওদের বয়স তো ৩০ এর ওপর নয়। ৩০ বছরেই ১১ টি বিয়ে? এদের অনেকেরই আয়ের সূত্র অজানা। কিন্তু এদের কেউ কেউ একটি নয়, দুটি নয়, তিন তিনটি বিলাসী দামি গাড়ি দাবড়ান। সিনিয়র পুলিশ অফিসার হারুন বলেছেন, এরা ‘রাতের রানী’। অন্যেরা বলেন, মক্ষীরানী। অভিজাত এলাকায় ৪ হাজার বর্গফুটের বাড়িতে বাস করেন এবং রাতে নরক গুলজার করেন।
এই বিষয় নিয়ে আমি লিখিনা বলে এসম্পর্কে আমার নলেজ খুব কম। তবে সাম্প্রতিককালে এসব কেলেংকারী কাণ্ড নিয়ে যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে আসছে, তারা হলেন, ক্যাসিনো সম্রাট জি কে শামীম, ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের শাহেদ, ডাক্তার সাবরিনা, ওসি প্রদীপ, কুয়েতের জেলে আটক সাবেক এমপি পাপুল, হেলেনা জাহাঙ্গীর, পাপিয়া, পিয়াসা, ঈশিতা, ঐশী, আনুশকা, মুনিরা, মৌ, পরীমনি প্রমুখ।

॥ দুই ॥
আমরা আলোচনা করছিলাম ভিকারুন্নেসার অধ্যক্ষ কামরুন্নাহারের টেলিফোন সংলাপ নিয়ে। এই সংলাপে তিনি যেসব স্ল্যাং উচ্চারণ করেছেন সেগুলো শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হয়। সেই ধরনের শব্দগুলো বলবো না। তবে অন্যগুলো শুনুন। তিনি এই সংলাপে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ৭ বার। এরপর আরেকটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ৬ থেকে ৭ বার। সেটি অশ্রাব্য। তাই উল্লেখ করছি না। তারপর আরেকটি গালি দিয়েছেন ৪ থেকে ৫ বার। সেটিও উল্লেখ করছি না। এই টেলিফোন সংলাপে ‘কুত্তার বাচ্চা’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন ৮ বার। এরপর আরও দুটি শব্দ তিনি চার-পাঁচবার ব্যবহার করেছেন। এগুলোও উল্লেখ করা যায় না। তিনি অভিযোগ করেছেন যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্র তিনি নিজেই দমন করতে জানেন। তার নিজস্ব বাহিনী আছে। পুরুষ লাগবেনা। তার নারী বাহিনীই যথেষ্ট। তারা তার শত্রুদেরকে রাস্তায় কাপড় খুলে পেটাবেন। তিনি নিজে বালিশের তলায় পিস্তল রেখে ঘুমান।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন। একজন ভিসি রাতের আঁধারে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। টাকা নিয়ে চাকরি দিচ্ছেন। নিজের মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে চাকরি দেয়ার জন্য চাকরির যোগ্যতার শর্ত শিথিল করেছেন। আরেকজন মফস্বলের একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। চার বছর মেয়াদ পূরণ করেছেন। কিন্তু এই চার বছরে পুরো একমাসও ক্যাম্পাসে থাকেননি। পুরো সময়টাই বলতে গেলে থেকেছেন ঢাকায়।
এসব নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিলে কোন কথা থাকে না। কিন্তু নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ অযোগ্য ব্যক্তিদের। কমিউনিস্ট পার্টির নুরুল ইসলাম নাহিদকে আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বানানো হয়েছিল। তার সময় স্কুল কলেজ থেকে ভার্সিটি- সর্ব পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। কিন্তু কয়জন অপরাধী ধরা পড়েছে? কয়জনের শাস্তি হয়েছে? মেডিকেলের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। সবগুলি কুকীর্তির তদন্ত হবে বলে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।

॥ তিন ॥
যখন যুবক ছিলাম তখন একটি ঢাকাইয়া প্রবাদ শুনতাম। সেটি হল, ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। আমাদের সমাজটার অবস্থাও হয়েছে অনেকটা সেরকম। যখন এই লেখাটি শুরু করি তখন পরীমনির বাসায় র‌্যাবের অভিযান শুরু হয়নি। হলে সেটি দিয়েই শুরু করতাম। লেখার মাঝখানে দেখলাম পরীমনির অন্তত ৪০ মিনিটের লাইভ ভিডিও। বুধবার এবং বৃহস্পতিবারের একাধিক পত্রিকা ঢাকার অন্ধকার জগতের খবরে ভরপুর। বুধবার রাতে পরীমনিকে র‌্যাবের উত্তরা অফিস নেয়া হয়েছে। রাতেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্ধকার জগতের আরো নতুন কিছু নাম এসেছে। এগুলো হলো, একা, আঁচল, শিলা, নায়লা, অহনা প্রমুখ। পরীমনি পিয়াসাসহ আরো অনেক মক্ষীরানীর গডফাদার নজরুল ওরফে রাজের অফিসে র‌্যাব অভিযান চালায়। এই রাজ নাকি এদের গডফাদার। এদের বাড়িতে মদ, মাদকসহ পর্ণফিল্ম পাওয়া গেছে। এসবের সবিস্তার বর্ণনা একাধিক পত্রিকায় এসেছে। সেই সবিস্তার বর্ণনা দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার প্রশ্ন ভিন্ন। সেখানেই যাচ্ছি।

॥ চার ॥
পরীমনি বা এই ধরনের মেয়েদের বাসায় এত বিপুল পরিমাণে শুধু মদই নয়, মাদকও আসে কোথা থেকে? আমি বেশিরভাগ মাদকের নাম জানিনা। কিন্তু সিসা, আইস এগুলোর নাম এবারই শুনলাম।
সাধারণত: গল্প-উপন্যাস বা সিনেমায় চরস, মারিজুয়ানা, হেরোইন, এলএসডি, গাঁজা- এগুলোর নাম শোনা যায়। মাদকের কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে সাম্প্রতিক অতীতে অনেকে এনকাউন্টারের শিকার হয়েছে। কিন্তু এগুলোর পেছনে কারা? সাপ্লায়ার কারা? ৫ আগস্ট ‘বাংলা ট্রিবিউনের’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পরীমনিসহ এই চক্রের সাথে উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কারা ঘনিষ্ঠ, তাদের নামও নাকি ওরা অকপটে বলে যাচ্ছে।
এবারই প্রথম নয়। এর আগে ক্যাসিনো সম্রাট এবং নারী ব্যবসায়ী শামীমা নূর পাপিয়া জিজ্ঞাসাবাদে তাদের গডফাদার বা মাফিয়া কিংদের নাম নাকি বলে দিয়েছেন। সেসব নাম পত্রিকায় আসেনা কেন? বছরের পর বছর ধরে নেপথ্য প্রভুরা নেপথ্যেই থেকে যাচ্ছেন। ওদেরকে প্রকাশ্যে না আনলে দিনের পর দিন পরীমনিদের জন্ম হতেই থাকবে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/460954