৭ আগস্ট ২০২১, শনিবার, ১২:৩৭

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

ধ্বংসের মুখে বই প্রকাশনা খাত

করোনাকালীন দেড় বছরে সরকার ঘোষিত নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে অনেক খাত কিছুটা সময় হলেও চালু ছিল। তবে এই পুরো সময়টা বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের লাইব্রেরিগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় দেশের ২৬ হাজার লাইব্রেরির সঙ্গে জড়িতরা চরম দুর্দশায় পড়েছেন। আর এতে ধ্বংসের পথে প্রকাশনা খাত।

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে চলছে পড়ালেখা। তবে একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই অনলাইন পড়ালেখার মধ্যে রয়েছে। মফস্বল ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অনেকটা পড়ালেখার বাইরে চলে গেছে। সরকার বিনা মূল্যের পাঠ্য বই দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা পড়ালেখা করছে না। আর সহায়ক বইয়ের কথা তো চিন্তাই করছে না। আগের স্বাভাবিক বছরগুলোয় শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সহায়ক বইও কিনত। কারণ, সৃজনশীল প্রশ্নে শুধু পাঠ্য বইয়ের ওপর নির্ভর করে পড়ালেখা করা প্রায় অসম্ভব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাডেমিক ও সৃজনশীল প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত ১২টি খাত চরম হুমকির মুখে রয়েছে। এই খাতগুলো হচ্ছে—পুস্তক প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতা, লেখক ও সম্পাদক, কম্পিউটার অপারেটর, গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও শিল্পী, প্রুফ রিডার, কাগজ, পেস্টিং, মুদ্রণ প্লেট, মুদ্রণ, কালি, বাঁধাই ও লেমিনেটিং এবং সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারী।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি বলছে, গত ১৬ মাসে দেশের একাডেমিক ও সৃজনশীল প্রকাশনা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বিক্রি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন ও পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য মাধ্যম থেকে ঋণ নিয়ে জর্জরিত হয়ে আছেন। অথচ যুগ যুগ ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষিত জাতি গঠনে দেশের অংশীদার হিসেবে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।

প্রতিবছর একুশে বইমেলায় সৃজনশীল প্রকাশনার বড় বিক্রি হয়। প্রকাশকরাও উৎসাহী হন। কিন্তু এ বছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হলেও প্রকাশক ও বিক্রেতারা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান স্টল নির্মাণের খরচ পর্যন্ত তুলতে পারেনি। তাই পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বইমেলার ১০ কোটি টাকার বই এবং সরকারিভাবে ১০০ কোটি টাকার বই কিনতে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গত দেড় বছরে প্রকাশনা খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়লেও এখনো কোনো ধরনের প্রণোদনা পায়নি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে তিন দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—পুস্তক ব্যবসা খাতের জন্য কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, যা যে কোনো তফসিলি ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, পিকেএসএফ প্রভৃতির মাধ্যমে সমিতির পরামর্শ ও সহযোগিতায় বণ্টন ও প্রদান করা যেতে পারে। প্রায় ২৬ হাজার পুস্তক ব্যবসায়ী পরিবারের জন্য এককালীন অনুদান বাবদ ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ, যা ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং সমিতির মাধ্যমে বিতরণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করতে একাডেমিক ও সৃজনশীল বইয়ের জন্য ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া।

সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা মূলত পুস্তক খাতের জন্য মহাদুর্যোগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা গভীরভাবে জড়িত। এই দুঃসময়ে প্রকাশনা খাতকে রক্ষায় সরকার যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে ভবিষ্যৎ জ্ঞাননির্ভর জাতি গঠন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে কোনো মূল্যে প্রকাশনা খাতকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’

পুথিনিলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে বই বিক্রির ওপর। একাডেমিক ও সৃজনশীল বই বিক্রি প্রায় বন্ধ। ২৬ হাজার বইয়ের দোকান বন্ধ থাকায় মালিক-কর্মচারীরা নিঃস্ব। অনেকে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকার এরই মধ্যে অন্য খাতে একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজ ও অনুদান দিলেও আমাদের খাতকে বিবেচনায় না রেখে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা খাতকে বাঁচাতে হলে প্রণোদনার বিকল্প নেই।’

লেকচার পাবলিকেশনসের কর্ণধার ও সমিতির সহসভাপতি প্রকৌশলী মেহেদী হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকাশনা খাত বলা যেতে পারে ধ্বংস হয়ে গেছে। যে লোকটা লাইব্রেরির মালিক, সে ইচ্ছা করলেই অন্য পেশায় যেতে পারবেন না। আসলে এই খাতে অর্থের চেয়ে জ্ঞানভিত্তিক চর্চাই বেশি হয়। সেই টানেই অনেকে প্রকাশনা, লাইব্রেরির সঙ্গে জড়িত। এই খাতকে সরকারের বিশেষ খাত হিসেবে দেখা উচিত। সরকারের উচিত হবে প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ বা বই কেনা যেকোনোভাবেই হোক এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখা। নয়তো শিক্ষিত জাতি গঠনে আমরা পিছিয়ে যাব।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/07/1060917