৭ আগস্ট ২০২১, শনিবার, ১২:৩৬

ভারতীয় ঋণে পণ্যসেবা ক্রয় বাধ্যতামূলক

মাদারগঞ্জে বৃহৎ সোলারপার্ক

লেজেগোবরে পাকিয়ে এক শ’ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পার্ক এখন জামালপুরের মাদারগঞ্জে। তিন বছর আগে এটি বাগেরহাটে করার অনুমোদন দেয়া হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনুমোদনের তিন বছর পর প্রকল্পটির স্থান পরিবর্তন করা হলো। এখন আবার নতুন করে অনুমোদন নিতে হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত (এলওসি) থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে । ঋণের নমনীয় শর্ত হলো ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক। ঋণ নেব, কিন্তু কোনো স্বাধীনতা নাই। আগামী মঙ্গলবার একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য যাচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক মো: আবদুস সুবর বলেন, অনুমোদন পেলেই আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারব। আশা করি নির্ধারিত মেয়াদেই সমাপ্ত হবে।

রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ অনুসারে জ্বালানি বহুমুখীকরণের জন্য ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৩ শ’ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে উৎপাদন করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে বাগেরহাটের মোল্লাহাটে এক শ’ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা ছিল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ শ’ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৮ সালে। যার অনুমোদিত ব্যয় ৮২ কোটি ৭০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। গত ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়ে মূল প্রকল্প শুরু করার কথা। কিন্তু সেটা আলোর মুখ দেখেনি। এখন নতুন করে মূল প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৩৪১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিল থেকে ১৯৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ভারতীয় ঋণ (এলওসি) থেকে এক হাজার ১৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং আরপিসিএলের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় জোগান দেয়া হবে।

প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, জামালপুরে যমুনা নদীর পাড়ে দেশের ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ঋণচুক্তি হয় গত ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এক হাজার ১১২ কোটি টাকা ঋণ দেবে ভারত। যার বাগেরহাটে নির্মাণ করার সময়ই চুক্তি হয়েছিল। ৩২৫ দশমিক ৬৫৩৬ একর জমির ওপর ২০ বছর মেয়াদি এ সোলার প্ল্যান্ট নির্মিত হবে।

এ দিকে, এই প্রকল্পের অগ্রগতির ওপর পর্যালোচনা সভার তথ্য হলো, ভূমি অধিগ্রহণ বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। গত ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল তাদের সাথে চুক্তি হয়। আর এই মোল্লাহাটে পাঁচ শ’ একর অফসলি ভূমিকে প্রকল্পের সাইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাদের মাধ্যমেই। এরপর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পরিবেশগত যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সম্মতি ছিল প্রকল্পটিতে। এমনকি বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে পাঁচ শ’ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছিল।

আরপিসিএল এই প্রকল্প সূত্র জানায়, ভূমি জটিলতাসহ নানা কারণে বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজটি অনুমোদন পেয়েও হয়নি। প্রকল্প এলাকায় জলাশয় থাকায় তা ভরাট করা হলে পরিবেশগত ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে জলাশয় ভরাট না করে ফিশারিজসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। একটি বিস্তারিত স্টাডির ভিত্তিতে সোলার প্যানেল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন প্রকল্প নতুনভাবে ডিজাইন করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। একনেক সভার নির্দেশনা অনুসারে বাগেরহাটে প্রকল্প এলাকার জলাশয়ে ফিশারিজসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের সুবিধা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে এ দু’টি পদ্ধতিতে মোল্লারহাট প্ল্যান্ট স্থাপনের উপযোগিতায় নেই। এর ফলে ২০১৪ সালে বিদ্যুৎ বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রকল্প যাচাই কমিটির সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মোল্লারহাটের পরিবর্তে জামালপুরের মাদারগঞ্জে নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।

ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানি প্রতিষ্ঠান এফজি অ্যান্ড কোং কেজি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে কাজ দেয়া হয়। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় পাঁচ শ’ একর জমিতে ১২৬.৭২ মেগাওয়াট পিক এর পরিবর্তে ৮৭.৫৫ মেগাওয়াট পিক ক্ষমতার বেশি সোলার পিডি পাওয়ার প্ল্যান্ট (মৎস্য চাষসহ) স্থাপন করা সম্ভব নয়। আর প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৫১৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং বিদ্যুতের মূল্য হার ১৯ টাকা ৫১ পয়সা অত্যধিক।

আরপিসিএল সূত্রে গেছে, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এই প্রকল্পের জন্য মাদারগঞ্জ উপজেলার জোড়াখালী ইউনিয়নের কাইজারচর মৌজায় যমুনা নদীর নিকটবর্তী এলাকায় সরকারি খাসজমি নির্বাচন করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ২০২০ সালে ৩২৫ দশমিক ৬৫ একর জমির দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যমুনা নদী প্রকল্প এলাকা থেকে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ফলে ওই এলাকার ভূমি তুলনামূলক স্থিতিশীল। এছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ওই এলাকায় বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি কম রয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের জন্য নদীর পাড়ে কোনো বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন হবে না। সৌর প্যানেলগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রকল্প এলাকার চার পাশে সাড়ে ছয় কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রকল্প এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ মিটার উঁচু হলেও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য ভূমি উন্নয়ন করে অতিরিক্ত দুই মিটার উচ্চতায় (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ মিটার) লেভেলিং করা হবে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আবদুস সবুরের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, আশা করছি একনেক অনুমোদন পেলেই আমরা দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে ময়মনসিংহ, জামালপুরের পাশাপাশি আমরা ঢাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারব।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/599887