৬ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১২:২৪

পরিকল্পনার গলদে হোঁচট গণটিকায়

ঢাকঢোল পিটিয়ে মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করে আয়োজন করা হয়েছিল শনিবার থেকে সপ্তাহব্যাপী এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার কর্মসূচি। এ নিয়ে সরকারের আগাম প্রশংসাও শুরু হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। মাঝে কিছুদিন টিকা নিয়ে সংকট ও মানুষের অসন্তুষ্টি কেটে যাচ্ছিল অনেকটাই। কিন্তু হঠাৎই বুধবার রাতে সরকারের ঘোষণায় অবাক হলো মানুষ। নতুন করে তৈরি হলো সমালোচনার ক্ষেত্র।

পুরো কর্মসূচি চূড়ান্ত করে আনার পর কোন পরিস্থিতিতে, কেন সাত দিনের ওই কর্মসূচি এক দিনে আটকে যায়, তা নিয়ে মানুষের সামনে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি সরকারের তরফ থেকে। বরং ১৪ আগস্ট ওই কর্মসূচি আবার শুরু হওয়ার তথ্য জানানো হলেও তার পরদিন জাতীয় শোক দিবস থাকায় ওই দিন আদৌ শুরু করা যাবে কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত সময়মতো টিকার মজুদ ঠিক রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে আবারও কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ায় কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। টিকাকেন্দ্রিক দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা ও এক ধরনের ‘অজানা ভয়ের’ কারণেই ঘটেছে এ ঘটনা। সপ্তাহব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি ঘিরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভেতরে আগে থেকেই সংশয় ছিল। কিন্তু ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকদের কাছে সঠিক চিত্র বোঝাতে সক্ষম হননি অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে আজ শুক্রবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক রাজধানীর মহাখালীর বিসিপিএস প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। সম্মেলনে এই কর্মসূচি পরিবর্তনের বিষয়ে ‘প্রকাশ্য’ কিছু ব্যাখ্যা থাকবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে গতকাল দিনভর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি চলেছে বলে জানান বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এমনকি টিকা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত কারো কারো মধ্যে ‘ভয়’ আরো বেড়ে গেছে বলে জানান তাঁরা। গতকাল অনেকেই ছিলেন চুপচাপ। নিয়মিত যাঁরা গণমাধ্যমে কথা বলতেন তাঁরাও গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেছেন।

যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই জানি যে বিশেষ কর্মসূচির কোনো প্রভাব চলমান নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমে পড়বে না। এটা যেভাবে প্রতিদিন চলছে তেমনভাবেই অব্যাহত থাকবে।’

উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে জানান দেওয়া হয় যে ৭ আগস্ট থেকে দেশে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সবার মধ্যে টিকা দেওয়া শুরু হবে। সাত দিনে প্রায় এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। হঠাৎই বুধবার রাতে গণমাধ্যম জানতে পারে, কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। সাত দিনের পরিবর্তে শনিবার শুধু এক দিন সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের তিনটি কেন্দ্রের প্রতিটিতে ২০০ জন করে মোট ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। পরে এই কর্মসূচি আবার শুরু হবে ১৪ আগস্ট থেকে। তবে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম যেমন আছে তেমনভাবে চলতে থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমও কালের কণ্ঠকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেন।

বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি জেলার সিভিল সার্জন কালের কণ্ঠকে গতকাল বলেন, ‘এখন তো আমাদের মার খাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা যেভাবে মানুষকে প্রস্তুত করেছি টিকা দেওয়া জন্য, তাতে সবাই খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমাদের কর্মীরা এলাকায় এলাকায় ঘুরে তালিকা ও নিবন্ধনের কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন এক হাজার ৮০০ মানুষকে টিকা দেওয়া জন্য। কিন্তু সেখানে এখন ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। বাকি মানুষ এখনই নানা প্রশ্ন করছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে। অনেকে বাস্তবতা বুঝতে পারছে, আবার অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। উল্টাপাল্টা কথা বলছে। ফলে শনিবারের এক দিনের কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের মধ্যে আছি।’

যদিও ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর বাইরে আমার প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে প্রস্তুতি রয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত মেনেই আমরা এক দিনের কর্মসূচি অনুসারে প্রতিটি ইউনিয়নের মোট ৬০০ জনকে টিকা দেব। বাকিদের অপেক্ষায় থাকার অনুরোধ করছি। সামনে আবার যখন ওপর থেকে নির্দেশনা আসবে সে অনুসারে কাজ হবে। আমরা প্রস্তুত থাকব।’ তিনি আরো বলেন, ‘কর্মসূচি দিন হিসাবে কমিয়ে আনা হলেও কাঠামো সব একই থাকছে। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কেন্দ্র থাকবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ২০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে তিনটি করে বুথ থাকবে। একেকটি বুথে দুজন টিকাদানকর্মী এবং তিনজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। প্রথম দুই ঘণ্টায় শুধু বয়স্ক ও নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা দেব, পরে অন্যদের দেওয়া হবে।’

একাধিক সূত্র জানায়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা ছিল, দ্বিতীয় ডোজ হাতে না রেখে আর কোনো টিকা দেওয়া হবে না। এখন হাতে আছে ৮০ লাখ টিকা। এর মধ্যে অক্সফোর্ডের ১৬ লাখ ডোজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ দেওয়া হবে শুধু বকেয়া দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে। বাকি টিকা থেকে দ্বিতীয় ডোজ হাতে রাখলে ৪০ লাখেরও কম মানুষকে দেওয়া যাবে। তার মধ্যে আবার নিয়মিত চলমান নিবন্ধনভুক্তদের টিকা কার্যক্রমে দিনে প্রায় তিন লাখ ডোজ লাগে। ফলে এর বাইরে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে দিনে গড়ে ৩০ লাখের বেশি টিকা কিভাবে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা অনেকে বুঝে উঠতে পারছে না। চলতি মাসে আরো এক কোটি ডোজ টিকা আসার সম্ভাবনা থাকলেও দুই ডোজ হিসাবে তা দেওয়া যাবে ৫০ লাখ মানুষকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের টিকা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত কারিগরি পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সঠিক মাত্রায় তথ্য আদান-প্রদান ও সমন্বয় না থাকার খেসারত দিতে হচ্ছে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগকে। তবে এত কিছুর পরও দেশে এক কোটির বেশি মানুষের টিকা পাওয়ার বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞরা কিছুটা ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গতকাল পর্যন্ত দেশে এক কোটি ৪৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৪ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন এক কোটি দুই লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৭ জন। অর্থাৎ দেশে কতজন টিকা পেয়েছেন, সেই প্রশ্নের জবাবে এই অঙ্কটিই উঠে আসে। দুই ডোজ পূর্ণ করেছেন ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৭ জন।

প্রথম ডোজ হিসেবে অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৬৩ জন। তাঁদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ জন। সিনোফার্মের প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৫৮২ জন। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৯২ হাজার ২৪৮ জন। ফাইজারের প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫০ হাজার ২৫৫ জন। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন সাত হাজার ৩৮ জন এবং মডার্নার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ১১ লাখ এক হাজার ৮৯৭ জন। মডার্নার টিকার এখনো দ্বিতীয় ডোজ দেশে শুরু হয়নি। বাকি তিনটি টিকারই দ্বিতীয় ডোজ চলছে রুটিন অনুসারে।

এদিকে সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুসারে ১৮ বছরের ওপরের মোট ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৫৬ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন ৮ শতাংশ আর দুই ডোজ পূর্ণ করেছেন ৪ শতাংশ মানুষ। তবে দেশের মোট জনসংখ্যা হিসাবে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ৫.৬১ শতাংশ এবং দুই ডোজ পূর্ণ হয়েছে ২.৫৪ শতাংশ মানুষের। টিকা গ্রহণের দিক থেকে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছে পুরুষ ৬৩ শতাংশ এবং নারী ৩৬ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এ পর্যন্ত সিনোফার্মকে সাড়ে সাত কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেড় কোটি টিকার মূল্যও পরিশোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি মাসে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় সিনোফার্মের ৩৪ লাখ ডোজ এবং অন্য আরো ১০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ফাইজার থেকে আগামী মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা আসবে।

টিকার বিশেষ কর্মসূচি বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতি সপ্তাহে এক কোটি হিসাবে দুই মাসে আট কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু টিকা পর্যায়ক্রমে আনতে হচ্ছে। তাতে একটু এদিক-ওদিক হতে পারে।

এদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই টিকা দেওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। কিন্তু গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারি করা নির্দেশনায় তা ২৫ বছরই রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ওই নির্দেশনায় মহানগর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত কিভাবে টিকা দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ক্ষেত্রবিশেষে ৭ থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত কোথাও কোথাও এই কর্মসূচির আওতায় টিকা দেওয়া যেতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2021/08/06/1060666