৬ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১২:২৩

ঝুঁকিতে শিশুরা

বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে রাজধানীতে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিনই দুই শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা গেছে দশ বছরের শাবাব। এডিসের কাছে হেরে গেছে সে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় গত সোমবার শাবাবকে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে। গত বুধবার রাতেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শাবাবের বাবা সারোয়ার হোসেন এটিএন নিউজের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তিনি পাগলের মতো হয়ে গেছেন। সহকর্মী সাংবাদিকরা তাকে শান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। শাবাবের মতো আরও অনেক শিশুই এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

চলতি বছরের শুরু থেকেই শঙ্কা ছিল বাড়বে ডেঙ্গু। ঘটছেও তাই। বিশেষ করে হাসপাতালের বিছানায় শিশুরাই বেশি। তবু টনক নড়ছে কই? দুই সিটির অভিযানে প্রতিদিনই মিলছে এডিস মশার লার্ভার দেখা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০৮ জন ঢাকায় ও বাইরের হাসপাতালে ১০ জন ভর্তি হন। এ নিয়ে দেশের হাসপাতালগুলোতে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৫ জন। ঢাকায় ২০৮ জন রোগীর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৬৩ ও বেসরকারি হাসপাতালে ১৪৫ জন ভর্তি হন। হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে এক হাজার ১২ ও বাইরের হাসপাতালে ৪৩ জন ভর্তি। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু সন্দেহে মৃত ১০ জনের তথ্য পর্যালোচনা করার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যু নিশ্চিত করেনি পর্যালোচন কমিটির সদস্যরা।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে মোট তিন হাজার ৯০১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন দুই হাজার ৮৩৬ জন রোগী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রæয়ারিতে নয়, মার্চে ১৩, এপ্রিলে তিন, মে মাসে ৪৩, জুনে ২৭২, জুলাইয়ে দুই হাজার ২৮৬ জন ছাড়াও ৫ আগস্ট এক হাজার ২৪৩ জন রোগী ভর্তি হন। পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন আবার শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর বিস্তারের জন্য মানুষের অসচেতনাই অনেকটাই দায়ী। বিশেষ করে এখনো নির্মাণাধীন ভবনে নেই কাঙ্খিত মাত্রার সচেতনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার অভিযানে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সবাইকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব, আসুন আমরা আমাদের এলাকাটাকে পরিষ্কার করি। আমরা আমাদের কনস্ট্রাকশন যেখানে হচ্ছে সেখানে পরিষ্কার রাখি। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন রাখাটা আমাদের অবহেলা, আমাদের অবজ্ঞা, আমরা ভাবি দেখি না কি হয়। এভাবে থাকলে জরিমানার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া শিশুদের প্রতি আরও যতœবান হতে অভিভাবকদের প্রতি আহŸান জানান তিনি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম (এনএইচসিএমসি)। এ কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ গতকাল বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শিশুরাই বেশি মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে যাদের বয়স ১২ বছরের নিচে তারাই আছে ঝুঁকির মধ্যে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে সেখানেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসি বলেন, গতবারের তুলনায় চলতি বছর রোগী ভর্তির সংখ্যা বেশি ঠিকই, তবে গতবার কিছুটা ইনফরমেশন গ্যাপ ছিল। তথ্যগুলো সেভাবে শুরুর দিকে আসেনি। আবার গত মাসে প্রকাশিত পোস্ট মনসুন সার্ভে অনুযায়ী এবারে আবাসিক এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব কম, কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেশি। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় এডিস মশা কম মানে হচ্ছে মানুষ সচেতন হয়েছে। কিন্তু নির্মাণাধীন ভবন, ড্রেন, পরিত্যক্ত মোটরযানসহ পরিত্যক্ত জায়গাগুলোতে এডিস পাওয়া গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡বিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, চলতি বছরের প্রথম এই তিনমাসে এডিস মশার যে ঘনত্ব পেয়েছি সেটা অনেক বেশি। এবারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বেশি। অর্থাৎ ডেঙ্গুর সিজনে রোগীর সংখ্যা বাড়বে যদি কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সব ‘ফোকাস’ চলে গেছে সেদিকে। তাই শঙ্কা হচ্ছে ডেঙ্গুর দিকটা দুর্বল না হয়। তিনি আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এডিস মশা নিধনে এবং এডিস মশার প্রজননস্থল কমানোর ওপর জোর দেন। ডেঙ্গুর প্রকোপের এ সময়ে বাসাবাড়িতে অব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রে পানি জমতে না দেওয়াসহ দিনে ও রাতে মশারি টানানোর পরামর্শ বিশেজ্ঞদের। প্রতিবছর বর্ষাকালেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ হারান। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।

এদিকে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র (ডিআরইউ) স্থায়ী সদস্য ও এটিএন নিউজের এডিটর (অ্যাসাইনমেন্ট) সারোয়ার হোসেনের পুত্র শাবাবের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। ডিআরইউ’র কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি মুরসালিন নোমানী ও সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন, ফুলের মত ফুটফুটে শিশুটির এভাবে চলে যাওয়া খুবই বেদনাদায়ক। মা-বাবাসহ পরিবারের জন্য কতটা কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা কঠিন। আল্লাহ তাদের ধৈর্য ধারণের শক্তি দিন। নেতৃবৃন্দ মরহুম শিশু পুত্রের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/405606/