৬ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১২:২০

সিনোফার্মের সাড়ে ৭ কোটি টিকার অর্ডার

টিকা নিতেও মানুষের সীমাহীন বিড়ম্বনা

করোনার টিকা কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। গতকাল রাজধানীর টিকা কেন্দ্রগুলোকে শত শত মানুষ ভিড় জমিয়েছেন টিকা গ্রহণের জন্য। ‘রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেখিয়েই করোনার টিকা নেয়া যাবে’ এ ধরনের সংবাদে মানুষ এসেছেন টিকা নিতে। টিকা কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় সামাল দিতে না পারায় হাঙ্গামা, হৈ-হট্টগোলও বাধে কোথাও কোথাও। টিকা নেয়ার লাইন কেন্দ্রের প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে রাস্তায় চলে এলে অনেক জায়গায় স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও কোথাও টিকা কেন্দ্রের কর্মীদের সাথে মারামারিতেও লিপ্ত হয় মানুষ।

এ দিকে আগামীকাল শনিবার (৭ আগস্ট) এক দিন সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের তিনটি করে কেন্দ্রে ৩০০ থেকে ৬০০ জনকে করোনার টিকা দেয়া হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নের তিনটি কেন্দ্রে শনিবার ৩০০ জনকে টিকা দেয়া হবে। এরপর আগামী ৭ দিন টিকা প্রদান কর্মসূচি সীমিত রাখা হবে। এর মধ্যে দেশের সর্বত্র চলমান টিকা কার্যক্রম চলতে থাকবে। এরপর আবার ১৪ আগস্ট থেকে এই কর্মসূচি চলবে। টিকা স্বল্পতার কারণেই এমন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। শনিবার প্রতিটি টিকা কেন্দ্রে অগ্রিম রেজিস্ট্রেশনের ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে। সে দিন বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ, নারী এবং প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীই গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ৭ আগস্ট (শনিবার) থেকে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। ৭ দিনের মধ্যে এক কোটি মানুষকে টিকা দিতে হলে প্রতিদিন সরকারকে ১৪ লাখ ২৮ হাজারের বেশি টিকা দিতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুসারে সারা দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম ও মডার্নাসহ সাত লাখ ৭৫ হাজার ৪৯১ ডোজ টিকা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে সরকারের কাছে যে টিকা মজুদ ছিল তার অনেকগুলোই দেয়া হয়ে গেছে। আগামী ৭ আগস্ট থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় এক কোটি টিকা যদি দেয়া হয় তাহলে টিকার ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে টিকা প্রদান চালানো যাবে না। আবার সারা দেশে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১৪ হাজার টিকাদান কেন্দ্র রয়েছে। যদি এক কোটি মানুষকে টিকা দিতে হয় তাহলে প্রতিটি কেন্দ্রে এক দিনে গড়ে ৭১৪ ডোজ টিকা দিতে হবে।

সিনোফার্মের সাড়ে ৭ কোটি টিকার অর্ডার
কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, চীনের সিনোফার্মকে সাত কোটি ৫০ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকার অর্ডার আমরা দিয়েছি। এর মধ্যে এক কোটি ৫০ লাখ টিকার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা এখন পর্যায়ক্রমে আসছে। বাকিগুলো নিয়ে কাজ চলছে।
সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে উৎপাদন করার জন্য সরকার ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে চীনের আলোচনা এগিয়ে চলেছে জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, গত ১৬ জুলাই সিনোফার্ম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যৌথ উৎপাদনের চুক্তির খসড়া দিয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তা দিয়েছি। তারা সেটা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় একদিনের মধ্যেই ভেটিং করে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে যেকোনো সময় এই চুক্তি সই হবে।

গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা জানান। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কোভ্যাক্সের (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগ) অধীনে ফাইজার-বায়োএনটেকের আরো ৬০ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে আসবে। ওরা জানতে চেয়েছিল, এই টিকা রাখার ব্যবস্থা আমাদের আছে কি না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আমাদের ব্যবস্থা আছে। সুতরাং আর কোনো সমস্যা নেই।

এর আগে গত ৩১ মে কোভ্যাক্স থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসেছে। ২১ জুন দেশে এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়। বর্তমানে টিকাটির দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কাজ চলছে। এ টিকা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সংরক্ষণ করতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় আলট্রা কোল্ড ফ্রিজার। আর পরিবহনের জন্য থার্মাল শিপিং কনটেইনার বা আলট্রা ফ্রিজার ভ্যান দরকার হয়। সংরক্ষণ আর পরিবহনে জটিলতার কারণে কেবল ঢাকায় বাছাই করা কয়েকটি কেন্দ্রে ফাইজারের টিকা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সিনোফার্মের টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরে দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। তাই এই টিকা সিটি করপোরেশনের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দেয়া হচ্ছে।

বিড়ম্বনা : গতকাল টিকা নিতে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন এমন অনেকে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তারা টিকার নিবন্ধন করতে পারেননি। নিবন্ধন কিভাবে করতে হয় তা তাদের জানা নেই। কম্পিউটার দোকানে গিয়ে টাকা দিয়ে নিবন্ধন তারা করেননি। কারণ এমনিতেই আয়রোজগার নেই। টিকা দেয়ার জন্য টাকা খরচ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ জানিয়েছেন, নিজেরা নিবন্ধন করতে পারেন না, নিবন্ধন করে দেয়ার মতো তাদের কেউ নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নেয়া যাবে এমন খবর শুনে তারা কেন্দ্রে এসেছেন টিকা নিতে। এমন লোকেরাই টিকা নিতে বেশি এসেছিলেন।

রাহেলা বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী মুগদা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্রে এসেছিলেন টিকা নিতে। তার কাছে ছিল জাতীয় পরিচয়পত্র। তিনি বলেন, কিভাবে নিবন্ধন করতে হয়, আমি জানি না। আমার একটা মোবাইল আছে; কিন্তু ইন্টারনেট নেই। সে কারণে পরিচয়পত্র নিয়ে চলে এসেছেন টিকা নিতে। মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে টিকা না নিয়ে ফিরে গেছেন তিনি।
মগবাজার নারী মৈত্রী টিকা কেন্দ্র থেকে একজন জানিয়েছেন, তিনি তার স্ত্রীসহ এসেছেন টিকা নিতে। তিনি আগে থেকেই নিবন্ধন করেছেন এবং এসএমএস পেয়েই টিকা নিতে এসেছেন; কিন্তু কেন্দ্রে অনেক ভিড়। এদের বেশির ভাগই নিবন্ধন না করেই এসেছেন। আবার নিবন্ধন ও তারিখ পেয়েও লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক ঘণ্টা। এখানে সরকারদলীয় লোকজন এসে লাইন ভেঙে নিজেদের লোকজন নিয়ে ভেতরে চলে গেছেন টিকা নিতে। এখানে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। যারা নিবন্ধন করেছেন তাদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। আবার অনেকে হাঙ্গামাও বাধিয়েছেন টিকা নিতে না পেরে। সরকারদলীয় পরিচয় দেয়া লোকজন কারো কারো গায়ে হাতও দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/599596