৬ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ১২:১৭

মন্ত্রীরা কি আউলাইয়া গেছে?

ঈদের ছুটির আগে পরে সকারের তরফ থেকে নানা আওয়াজ শুনলাম। কিসে মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, কিসে ভোগান্তি, কী মানুষের প্রয়োজন ও সহনশীল সে বিষয়ে সরকারের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হলো না। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। আমিও যেতাম- এখন থেকে ২০ বছর আগে পর্যন্ত। এখন গ্রামে আমার কেউ নেই। আমিও আর গ্রামের দিকে ছুটি না। গ্রামে যাওয়ার আর এক আপদ চাঁদাবাজি। একটু আলসেমি করে দেরীতে উঠবেন সকালে, তার কোনো সুযোগ নেই। কারণ নানা ধরনের চাঁদাবাজ উঠানে কলরব করতে থাকে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠে উঠানে দেখতে পাবেন কমপক্ষে পাঁচ দল চাঁদাবাজ। আমরা একটা সাংস্কৃতিক ক্লাব করেছি। আপনি এলাকার গণ্যমান্য লোক। কিছু সহায়তা আশা করছি। ঐ টিম বেরিয়ে যেতেই সামনে এগিয়ে আসে আর একদল। তারা ঈদ গা ময়দানে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেছে। কিছু সহায়তা চাই। তাদের বিদায় করতেই এগিয়ে আসে আর এক দল। তারা একটি কিন্ডার গার্টেন করেছে। টিনের ছাপরা তৈরি করবে। কিছু সহায়তা চাই। এরপর আসে বুক ক্লাব। তারা বই কেনার জন্য কিছু সহায়তা চায়। এরা ঠিক পেশাদার চাঁদাবাজ নয়। চাঁদা না দিলে বন্দুক বাগিয়ে গুলি করবে, এমনও নয়। কিন্তু গ্রাম জুড়ে হক-না-হক নিন্দা করবে। টাকা পয়সার ভয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে মানসম্মানের ভয়ে এদের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হয়। আমি এদের ভয়ে এখন আর গ্রামে যাই না। সকাল বেলা শান্তিতে, আলস্যে ঘুমিয়ে উঠবো এটাও গ্রামে এখন আর নাই। অন্তত এটাই আমার অভিজ্ঞতা। কিন্তু যারা ফি বছর ঈদে বা পার্বনে গ্রামে যান তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। আমি এখন প্রবীণ। আমার এসব ভাল লাগে না।

বাংলাদেশ এখনও গ্রাম প্রধান জনপদ। আমরা শিক্ষা কিংবা কর্মসংস্থানের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি। কিন্তু শহুরে চাকচিক্য আমাদেরকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যে, আমরা শহর ছেড়ে আর গ্রামে ফিরে যেতে চাই না। শহরে লেখাপড়া করি, শহরে চাকরির সংস্থান করি। তারপর শহরেই ছোট একটি ফ্ল্যাট কিনি এবং চিরকালের জন্য উন্মূল হয়ে যাই। এই সরল অঙ্কের সঙ্গে যারা নেই, তারা জীবন বাজি রেখে গ্রামের দিকে ছোটেন। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। আমরা নাগরিক হতে আরো সময় লাগবে।

ফলে শুধু রাজধানি ঢাকা ছেড়ে ঈদ বা লম্বা ছুটিতে গ্রামে যান কোটি লোক। কোনো কষ্ট, যাত্রার বিড়ম্বনা, ভাড়া, লকডাউন কোনো কিছুই তাদের রোধ করতে পারে না। আমরা লক্ষ্য করেছি, এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার সবসময় আউলাইয়া যায়। এই বলে বাস চলবে, এই বলে বাস চলবে না। এই বলে লঞ্চ চলবে, এই বলে লঞ্চ চলবে না। এই বলে লঞ্চ চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। তারপর বলে না, লঞ্চ চলবে আগামীকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত। এই এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। মানুষ যাবার জন্য ছুটছে তো ছুটছেই। যানবাহন চলবে না। অতএব হল্ট। থেমে যাও। না না যানবাহন চলবে, এগিয়ে যাও। এরকম ঘটনাই ঘটেছে ঈদের সময় গ্রামমুখী মানুষের ক্ষেত্রে। যখন দেখা গেল ‘কঠোর লক ডাউন’ দিয়েও জন¯্রােত রোধ করা যাচ্ছে না। তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, মানুষকে যেতে দিতে হবে। তখন সিদ্ধান্ত হলো, রাত ১০টায় যে রাত ১২টা থেকে পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত লঞ্চ চলবে। দূরপাল্লার বাসও চলবে।

এখানে বিবেচনায় নেয়া হলো না যে, ১০টায় ঘোষণা দিয়ে রাত ১২টায় কিভাবে লঞ্চ চলাচল শুরু হবে। লঞ্চ মালিকদের বক্তব্য ছিলো এই যে, একটি লঞ্চ চালাতে বিশ/ত্রিশ জন কর্মচারি প্রয়োজন। তাদের সবাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছে। কারণ তখন লকডাউন চলছিলো। এই লকডাউনের ভেতরে তাদের ফিরে আসার সহজ কোনো পথ ছিলো না। আপনি যদি লঞ্চ চালাতে চান, তাহলে কর্মচারীদের আনতে হবে। লকডাউনের কারণে সে পথও তো বন্ধ। ফলে সরকার ঘোষণা দিলেও মাত্র ১২ ঘণ্টার জন্য ঢাকা-বরিশাল বা ভোলার দিকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি বা এসব স্থান থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে আসেনি। তারপর আবার লঞ্চ চলাচলের মেয়াদ বারো ঘণ্টা বাড়ানো হলো। যা কার্যত কোনো কাজেই লাগেনি। সরকার বললো, দূরপাল্লার বাস চলবে ১২ ঘণ্টার জন্য। কিন্তু লকডাউন বহাল থাকবে। এ সবই সরকারের পুরোপুরি অদূরদর্শিতাÑ আউলা-ঝাউলা সিদ্ধান্ত। এগুলো কোনো ফল দেয়নি। মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছিল মাত্র।

ঈদ হলো ২১ জুলাই। ২২ তারিখ বন্ধ। সরকার ঘোষণা করলো ২৩ জুলাই থেকে রফতানিমুখী সকল শিল্প কারখানা খুলে দেয়া হবে। আবার চাকরি বাঁচাতে গ্রাম থেকে শহরের দিকে ছুটলেন লাখ লাখ মানুষ। তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাগ-ব্যাগেজ, বাচ্চা-কাচ্চা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফেরত যাওয়াও ছিলো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। যে যেভাবে পারছেন, ট্রাকে, কাভার্ড ভ্যানে। অটোতে, রিকশায় তিন-চারশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ফিরেছে। চব্বিশ তারিখের পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে যে, নব্বই শতাংশ গার্মেন্ট কর্মী সকল বাধা অতিক্রম করে তারা কাজে যোগ দিয়েছে।

পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই এক তৃতীয়াংশ কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। বাংলাদেশে গার্মেন্ট কর্মীরা সে ঝুঁকি নিতে চাননি। আস্তে আস্তে ঢাকায় আগমণ-প্রত্যাগমণ সহজ হয়ে আসছে। কিন্তু বাড়ছে করোনার প্রাদুর্ভাব। বাড়ছে মৃত্যু। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা।

এর মধ্যে এক মন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসলেন যে, ১৮ বছরের বেশি বয়সের কেউ যদি টিকার সনদ ছাড়া রাস্তায় বের হয়, তবে তাকে জেল-জরিমানা করা হবে। এ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে পড়ে মানুষ। যেখানে এখন সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ২৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সের সকলকে টিকা দেয়া হবে। এটাও এখনও ‘হবে’র পর্যায়েই রয়ে গেছে। কারণ ঐ বয়সের সকলকে টিকার আওতায় আনতে কমপক্ষে ২০ কোটি ডোজ টিকা লাগবে। সরকারের হাতে আছে বড় জোর ৫০ লাখ ডোজ। কবে, কোথা থেকে টিকার আমদানি হবে, তার কোনো হদিস নেই। আগেই টিকার সনদ চাইছে সরকার। আবার এই সাজা দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হবে পুলিশকে। মঙ্গলবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর সরকারের দুইমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও জাহিদ মালেক এসব কথা জানান।

এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, কিংবা কতটা বাস্তবসম্মতÑ মোসাহেবি করতে করতে মন্ত্রীরা সেসব কথা ভুলেই যান। তখন মনে সংশয় হয়, সব সময় তারা প্রকৃতিস্থ থাকেন কিনা। মনে হয়, নিজেদের ‘বিপ্লবী’ সাজানোর জন্য তারা অবলীলায় এসব অযৌক্তিক কথা বলেন। তারা বললেন, টিকা ছাড়া চলাফেরা করা অপরাধ। অথচ সরকারের টিকা সংগ্রহের মুরোদই হয়নি। সরকারের মন্ত্রীরা শুধু কুমীরছানা দেখায়। এখন সরকারের টিকা সংগ্রহ শুধুমাত্র ‘অনুদান’ বা ভিক্ষানির্ভর। সরকার বলতে পারছে না- এই বিপুল সংখ্যক টিকা তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করবে কিংবা কোনো উৎপাদনকারীর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। ফলে টিকা নিয়ে রয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। এখন যে ৫০/৬০ লাখ ডোজ টিকা সরকারের হাতে রয়েছে, তা দিয়ে কয় দিন চলবেÑ তারপর কী?

কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সরকার উপলব্ধি করল যে, টিকা না নিতে পারা কোটি কোটি মানুষকে তাদের এক ঘোষণায় ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করার সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি। তখন তারা বললো, ঐ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাছাড়া জরিমানা বা সাজা দেয়ার ক্ষমতা পুলিশকে দেয়ার মানে আরও এক দফা জনগণের ওপর নির্যাতনের সুযোগ করে দেয়া। সে ক্ষমতার অপব্যবহার অবধারিত ছিল। সব কিছুতে পুলিশ লাগাবেন কেন। বিচার বিভাগের হাতেও কিছু ক্ষমতা সংরক্ষিত থাক।

এই যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিবর্তন- এটা কোনো স্বস্থিরতার লক্ষণ নয়। এতে মনে হয়, সরকারের ভেতর থেকে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। কে কখন কোথায় কী বলছে, ধূলায় অন্ধকার। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব বিশৃঙ্খলা মানুষের মনে অনর্থক বিরক্তি সৃষ্টি করে। আর বল প্রয়োগ করে আইন মানানো যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জেল-জরিমানা কোনো সমাধান নয়। সমাধান মানুষকে বোঝানো। এখন দেখা যাচ্ছে, মাস্ক ও স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মধ্যেই সমাধান। সরকারকে সে পথেই অগ্রসর হতে হবে।

https://dailysangram.com/post/460673