৪ আগস্ট ২০২১, বুধবার, ১২:১৫

টিকার আওতা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা

মাঝে কিছুদিন ধীরগতি থাকলেও এখন দেশে টিকা আসার গতি বেড়েছে। টিকা প্রয়োগের আওতাও বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে শুরু হয়েছে নানামুখী বিশৃঙ্খলা। টিকাদানের ক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতিও হাসপাতালগুলোর পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়ায় একজন সংসদ সদস্যের প্রভাবে ও তাঁর ভাইয়ের নেতৃত্বে নিয়ম ভেঙে দুই হাজার ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলে একজন স্বাস্থ্যকর্মী টিকা না দিয়ে তা সিরিঞ্জে ভরে ফেলে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ব্যক্তি একই সময় তিন ডোজ টিকা নিয়েছেন বলে দাবি। কুষ্টিয়ায় একই ব্যক্তিকে একই সময়ে দুই ডোজ টিকা দেওয়া। টিকার জাল সনদ দেওয়া। এসব ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক মানুষ নিবন্ধন করেও এসএমএস না পেয়ে টিকার জন্য অপেক্ষা করছেন তিন-চার সপ্তাহ ধরে। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়মের মাধ্যমে নতুন নিবন্ধনকারীদের অনেকেই এসএমএস ছাড়া টিকা নিয়ে আসছেন। আগামী ৭ আগস্ট থেকে সারা দেশে একযোগে ব্যাপক হারে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে আরো বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার করোনাসংক্রান্ত একটি সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, আগামী ১১ আগস্ট থেকে টিকা না দেওয়া কেউ বাইরে বের হতে পারবে না। বের হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে ১১ আগস্টের মধ্যে দেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের সব মানুষকে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা না গেলে ওই নির্দেশনা কিভাবে কার্যকর করা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে এখন যে পরিমাণ টিকা আছে এবং চলতি মাসে আরো যে পরিমাণ আসবে, তা দিয়ে প্রত্যেকের জন্য দুই ডোজ টিকা নিশ্চিত করা যাবে কি না সে প্রশ্নও উঠেছে। সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গতকাল জাপান থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ছয় লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ ডোজ টিকা আসার মধ্য দিয়ে দেশে এ পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠানের দুই কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা এসেছে। এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক কোটি ১৮ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০ ডোজ (কেনা ৭০ লাখ এবং ভারত সরকারের উপহার ও জাপানের সহায়তায় কোভ্যাক্স থেকে ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০ ডোজ), ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ, সিনোফার্মের ৮১ লাখ ডোজ এবং মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ। এর মধ্যে সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট টিকা দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ ৮৯ হাজার ২০১ ডোজ, যার মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৯৬ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৭ জন এবং দুই ডোজ পূর্ণ করেছেন ৪৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৪ জন। এ ছাড়া টিকার জন্য গতকাল বিকেল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন মোট এক কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫ জন।

টিকাদান কার্যক্রম সফল করার জন্য গতকাল মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে সবাইকে সহায়তার নির্দেশনা দেন। পাশাপাশি সভায় এ পর্যন্ত টিকা নিয়ে সংগঠিত বিশৃঙ্খলার ব্যাপারেও আলোচনা হয় বলে সভা সূত্র জানায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে একই সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা যার যার অবস্থান থেকে টিকা কার্যক্রম সফল করার জন্য কাজ করবেন বলে জানান। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে সমাজসেবক, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল নেতাকর্মীরাও সহায়তা করবেন বলে জানায় দলীয় সূত্র। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, টিকাদান কার্যক্রমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবার কাছ থেকে আমরা সহায়তা চাই। অন্যদের সহায়তা ছাড়া এককভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে এই মহামারি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। টিকাদান কার্যক্রম হচ্ছে এই মহামারি থেকে সুরক্ষার বড় একটি অংশ। সেই টিকা নিয়ে যদি দেশের মানুষই নানাভাবে অনিয়মে জড়িত হয় বা ঘটায়, তবে আমরা কিভাবে সামাল দেব।’ তিনি বলেন, এরই মধ্যে দুটি কমিটি করা হয়েছে এসব বিষয় মনিটরিংয়ের জন্য। যেখানেই কোনো অনিয়ম দেখবে, তারা ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে এবং অনিয়ম যাতে না ঘটে সে জন্যও কাজ করবে।

টিকার সংকুলান বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, এখন যে হারে টিকা আসছে, তাতে টিকা নিয়ে সংকট আপাতত নেই। তবে যদি আবার কোনো অনিবার্য কারণে সামনে টিকা আসার গতি কমে যায়, তবে হয়তো টিকাদানের গতিতে প্রভাব পড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৭ আগস্ট থেকে পরিকল্পনা অনুসারেই ঢাকাসহ সারা দেশে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হবে। ১৮ বছরের ওপরের সবার টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা হবে। অগ্রাধিকার পাবেন বয়স্করা। যাঁরা নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাঁরা কেন্দ্রে এসেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নিতে পারবেন। এমনকি যাঁদের আইডি কার্ড নেই, তাঁরাও বিশেষ উপায়ে টিকা পাবেন।

এখন যেসব হাসপাতালে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোতেও শুরু হয়েছে নানা ধরনের তালগোল। হাসপাতালগুলোর পক্ষে একদিকে রোগী সামলানো, অন্যদিকে টিকা কার্যক্রম সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি হাসপাতালের পরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। একই দিনে যখন কোনো কেন্দ্রে প্রথম ডোজ ও দু-তিনটি টিকার দ্বিতীয় ডোজ দিতে হচ্ছে, তখন সেখানে তিন গুণ টিকাপ্রার্থীর সমাগম হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা তো হবে। এর মধ্যে আবার আছে বিদেশগামীদের অগ্রাধিকার। নতুন যাঁরা নিবন্ধন করেও এসএমএসের আশায় আছেন, তাঁদের এসএমএস দিয়ে টিকা দিতে চার-পাঁচ মাস সময় লেগে যাবে। এখন উপায় হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে কোনো অডিটরিয়াম বা স্টেডিয়ামে ক্যাম্প করে টিকা দেওয়া। না হলে সামনে কিন্তু বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে শিগগিরই হাসপাতাল থেকে টিকাকেন্দ্র সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছি। এখন আর হাসপাতালে টিকাকেন্দ্র রাখার দরকারও নেই। কারণ টিকাগ্রহীতাদের হাসপাতালে ভর্তির মতো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিল আহম্মেদ বলেন, ‘দিনে এক হাজার ৬০০ জনকে আমরা টিকা দিচ্ছি। কিন্তু একই দিনে তো দ্বিতীয় ডোজও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের তো এত জনবল নেই। রোগী ফেলে ওয়ার্ড থেকে নার্স এনে কাজ করতে হচ্ছে। এখন টিকার নিবন্ধন করা আছে ২৪ হাজারের বেশি।’

কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে এক লাখেরও বেশি নিবন্ধনকারী, সেখানে অবস্থা আরো জটিল। একই অবস্থা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/04/1059915