৪ আগস্ট ২০২১, বুধবার, ১২:০৯

বিপর্যস্ত শিক্ষা ও জাতির ভবিষ্যৎ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আগে প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। অফিস-আদালত, কল-কারখানা ও গণপরিবহনেও ফিরে এসেছিল প্রাণচাঞ্চল্য। স্বস্তিও ফিরে এসেছিল জনজীবনে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধুই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার প্রথম ঢেউ স্তিমিত হলেও দেশের শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধই থেকেছে। বারবার প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েও তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্র্র্র্র্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জাতীয় শিক্ষা।
সম্প্রতি সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান ছুটি আবারও বাড়ানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সারাদেশের করোনা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ায় ও কঠোর লকডাউন কার্যকর থাকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শক্রমে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এবতেদায়ি ও কওমি মাদরাসার চলমান ছুটি আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দেশে করোনা শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। ভাইরাসের বিস্তাররোধে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু আর খোলা হয়নি।
শুধু আমাদের দেশে নয় বরং করোনাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। দীর্ঘ পরিসরের এই ছুটিকে কেউই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। বিষয়টি দৃষ্টি এড়ায়নি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। ইউনিসেফের প্রেস অফিসার ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কুল খোলা রাখার কথা জানিয়ে বলেছেন, জোর করে স্কুল বন্ধ রাখার কারণে বিশ্ব শিক্ষা সংকটের কবলে পড়েছে। তার ভাষায়, বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ করার ফলে শিক্ষা সংকট ছাড়াও আগামী কয়েক দশক ধরে বহু দেশের সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে। যার পরিণতিতে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে শিশুরা, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের। যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।
সম্প্রতি ইউনিসেফ এক জরিপে বলেছে, বিশ্বের যে ১৪টি দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেছেন, ‘করোনার দ্বিতীয় বছরেও শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না বা সীমিতভাবে লেখা পড়া করবে তা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্কুল খোলাকে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার। এরজন্য পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’। কিন্তু পরামর্শ আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়তে বাড়তে ইতোমধ্যেই ৫শ দিন পার করেছে। অথচ জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যেও দেশের শিল্পকারখানাগুলো চালুই ছিল। ঈদ পরবর্তী সীমিত কয়েক দিনের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও ১ আগস্ট আবারও খুলে দেয়া হয়েছে। তাদের চলাফেরার জন্য সীমিত পরিসরে হলেও গণপরিবহনও চালু হয়েছে। কিন্তু দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ বিবেচনায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেই। করোনা উচ্চসংক্রমন রোধের কথা বলে দীর্ঘ এই ছুটিতে ক্লাসের বিকল্প হিসাবে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে টিভিতে ও অনলাইনে। তবে ভার্চুয়ালি এই বিকল্প মাধ্যমে ক্লাস পরীক্ষা চললেও শিক্ষার্থীদের পঠন ও শিখন নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। এই ধরনের শিক্ষাকার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা কতখানি উপকৃত হচ্ছে তা নিয়েও নানা হিসাব করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষাকার্যক্রমের যে গতি থাকার কথা ছিল তা শ্লথ হয়ে পড়েছে। অস্তিত্বে সঙ্কটে পড়েছে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা জাতির গন্তব্যকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ছুটি শিক্ষার্থীদের কাছে কাক্সিক্ষত হলেও করোনার কারণে এই দীর্ঘ পরিসরের ছুটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের হতাশার সৃষ্টি করেছে। অনলাইন ক্লাসে মিলছে না কাক্সিক্ষত ফল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক নয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যা সংশ্লিষ্টদের একগুয়েমী বলেই মনে করা হচ্ছে। শর্ত সাক্ষেপে সবকিছুই চালুর সুযোগ থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে জনমনে নানাবিধ প্রশ্নেরও সৃষ্টি হয়েছে।
দীর্ঘ পরিসরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। একাধারে দীর্ঘ সময় বাসা-বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডা ছাড়া একাকী থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মানসিক চাপ, হতাশা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ আবার বিপথগামীও হয়েছে। অবসর কাটানোর জন্য এসব শিক্ষার্থীরা নানাবিধ বদঅভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে অহেতুক আড্ডা, গেমস, স্মার্টফোন ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর ও নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। করোনা উত্তর সময়ে এসব শিক্ষার্থীরা আবার পুরোদমে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন।
দীর্ঘ এই বন্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ভর সেসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের বিপাকে পড়েছে। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরাও আর্থিক কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ি প্রায় ৬০ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কিন্ডারগার্টেন আর্থিকভাবে দৈন্যদশায় রয়েছে। সরকারের কাছে প্রণোদনার আবেদন করেও কোন সাড়া মেলেনি। এমতাবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে কিংবা বাসা হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। যা জাতির জন্য মোটেই সুখবর নয়।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ছুটির এই দীর্ঘ সময় শিক্ষক-কর্মচারিরা অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন বিক্রি করে দিয়েছেন। অবিভাবকরা বলছেন, শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। স্কুল খোলার পর প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে পড়ালেখায় আগ্রহী করে তোলারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সরকার কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবে তার কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সমস্যা আরও গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শেষ হলে অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া কবে নাগাদ শেষ করা হবে তার কোন সময়সীমা তিনি উল্লেখ করেননি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার যে গতিতে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাতে দেশের সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে ৫৭ বছর সময় লেগে যাবে। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে কত সময় লাগবে তা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ক্রমেই বাড়ছে।
দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ পরিসরে বন্ধ থাকায় বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও বিষয়টি নিয়ে সরকার সহ শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তারা সাক্ষীগোপাল হিসাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের কথায় ফলাও করে প্রচার করে আসছেন। কিন্তু অনলাইন শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নয়। বিষয়টি সীমিত পরিসরে কার্যকর হলেও দীর্ঘ পরিসরে কোন ভাবেই ফলপ্রসূ হতে পারে না। আর এক্ষেত্রে আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এখনও আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সকল শিক্ষার্থীদের হাতে এখন পর্যন্ত স্মার্টফোনসহ প্রয়োজনীয় ডিভাইসও তুলে দেয়া যায়নি। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষায় অভ্যস্তও হয়ে ওঠেনি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, অনলাইনে কেনাকাটা ভালো করা যায়। কিন্তু শিক্ষা অর্জনে শতভাগ সফলতা আসে না। তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো এবং ধারাবাহিক শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। কিন্তু বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা কোনভাবেই গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বন্ধকালে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। সীমিত সিলেবাসে এসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পেয়েছেন অটোপাস। যা শিক্ষার্থী মেধা ও মনন বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসাবেই মনে করা হচ্ছে। তবে এবার অটোপাস না দিয়ে সীমিত সিলেবাসে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিতে পারছে না। ভর্তি পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে আমাদের জাতীয় শিক্ষাই এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকারের কোন কর্মপরিকল্পনা আপাতত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
শিশুদের এখন যে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে তাতে চাইল্ড সাইকোলিস্ট-এর পাঠ থাকা খুবই জরুরি মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা চার থেকে আট গুণ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য সারা বিশ্বে এখন ব্যাক টু স্কুল প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেই উদ্যোগ নেয়া উচিত। কিন্তু সরকার বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করে কোন সম্ভবনাকেই কাজে লাগাচ্ছে না।
মূলত দীর্ঘ পরিসরে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের জাতীয় শিক্ষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই দেশ ও জাতিকে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনের সীমিত পরিসরে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে সম্ভাব্যতাও যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যথায় জাতীয় বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে না।

https://dailysangram.com/post/460474