গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে তোলা। ছবি : শেখ হাসান
৩ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:০১

আইইডিসিআর ও বিএসএমএমইউয়ের পৃথক গবেষণার ফল

টিকা না নেওয়া রোগীদের ১০ গুণ মৃত্যুঝুঁকি

যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁদের তুলনায় যাঁরা নেননি, তাঁদের করোনাভাইরাসে মৃত্যুঝুঁকি ১০ গুণ বেশি বলে আইইডিসিআরের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। অন্যদিকে বিএসএমএমইউয়ের এক গবেষণা জানিয়েছে, যাঁরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, তাঁদের ৯৮ শতাংশের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। বাকি ২ শতাংশ আগে থেকেই ‘ইমিউন কম্প্রমাইজড’ ছিল। তবে টিকার ফলে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি কত দিন পর্যন্ত টিকে থাকে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আইইডিসিআরের গবেষণাটি বলছে, দেশে টিকা না নেওয়া যেসব মানুষ কভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার ৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে তিনজন। আর টিকা নেওয়ার পরও যাঁরা কভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মৃত্যুহার মাত্র ০.৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি এক হাজারে তিনজন। এই হিসাবে বলা যায়, টিকা নেওয়া কভিড রোগীদের চেয়ে টিকা না নেওয়া কভিড রোগীর মৃত্যুঝুঁকি ১০ গুণ।

গত রবিবার রাতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে ‘কভিড-১৯ রোগের ওপর ভ্যাকসিনের প্রভাব’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। চলতি বছরের মে ও জুন মাসে দেশে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তদের ভেতর থেকে দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে এক হাজার ৩৩৪ জন রোগীর ওপর এ গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, টিকা না নেওয়া কভিড আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১১ শতাংশের শ্বাসকষ্ট দেখা গেছে, আর দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর কভিডে আক্রান্ত হওয়া রোগীর মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা গেছে ৪ শতাংশ রোগীর। আবার টিকা না নেওয়া কভিড রোগীর মধ্যে ৩ শতাংশের আইসিইউ প্রয়োজন হয়েছে, কিন্তু টিকা নেওয়া রোগীর মধ্যে আইসিইউ প্রয়োজন হয়েছে ১ শতাংশের।

ওই ফলাফলের বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ত্রিশোর্ধ্ব এক হাজার ৩৩৪ জন রোগীর মধ্যে ৫৯২ জন রোগী ছিলেন যাঁরা কভিডের টিকা এক ডোজও নেননি। অন্যদিকে ৩০৬ জন ছিলেন যাঁরা দুই ডোজ টিকা নেওয়ার অন্তত ১৩৪ দিন পরে আক্রান্ত হয়েছেন। আর আক্রান্ত হওয়া এই রোগীদের শনাক্ত হওয়ার কমপক্ষে ১৪ দিন পার হওয়ার পর এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

এই গবেষণায় দেখা যায়, টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত রোগীর তুলনায় টিকা না নেওয়া আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা ১০ শতাংশের বেশি ছিল। আবার হাসপাতালে ভর্তির হার টিকা না নেওয়া রোগীর ক্ষেত্রে ছিল ২৩ শতাংশ এবং টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির হার ছিল ৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে আগে থেকে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা কভিডে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের ভেতর হাসপাতালে ভর্তির হার ছিল ৩২ শতাংশ, টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল ১০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে একের অধিক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কভিডের টিকা নেওয়া রোগীর তুলনায় টিকা না নেওয়াদের হার ১৬ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়।

আইইডিসিআরের ওই ফলাফলের উপসংহারে বলা হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড রোগে পূর্ণ ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের তুলনায় টিকা না নেওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকহারে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা, অধিকহারে হাসপাতালে ভর্তি এবং অধিক মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি পূর্ণ ডোজ কভিড টিকা নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের আওতায় ২০৯ জন কভিড পজিটিভ রোগীর ওপর টিকার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা হয়। ‘হেমাটোলজিক্যাল প্যারামিটার্স অ্যান্ড অ্যান্টিবডি টিকার আফটার ভ্যাকসিনেশন অ্যাগেইনস্ট সার্স-কোভ-২’ শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফল গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে।

গবেষণাটি বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কভিড টিকা গ্রহণকারী যে ২০৯ জনের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে, তাঁদের অর্ধেকের বেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে জড়িত ছিলেন এবং তাঁদের তিন-চতুর্থাংশই পুরুষ। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ আগে কভিড আক্রান্ত হয়েছিল। আবার অর্ধেকের বেশি রোগী আগে থেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানিসহ অন্যান্য রোগে ভুগছিলেন। তবে এ ধরনের রোগীর মধ্যে টিকা গ্রহণের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়নি। ৪২ শতাংশ টিকা গ্রহণের পর মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্য জানিয়েছেন। তবে কারো মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধা বা অন্য কোনো জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। অন্যদিকে টিকা গ্রহণকারীর মধ্যে গড়ে ৯৮ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যাঁরা আগে কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অ্যান্টিবডির মাত্রা তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দীন শাহ জানান, টিকা দেওয়ার ফলে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় কি না এবং টিকা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত অন্য টিকার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় কি না সেটা দেখার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, কভিড মোকাবেলায় টিকাদান কর্মসূচি সার্থক করার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।

এদিকে গতকাল দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া আবার শুরু হলেও তা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। ঢাকায় আপাতত এই টিকা দেওয়া শুরু হলেও আগামী ৭ আগস্ট থেকে সারা দেশে দেওয়া হবে বলে আগেই জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গতকাল অক্সফোর্ডের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র সাত হাজার ২৮ জনকে। অন্যদিকে সব মিলিয়ে গতকাল দেশে টিকা দেওয়া হয়েছে তিন লাখ ছয় হাজার ৯৪৭ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৬৮৫ জনকে এবং দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে মোট ১৬ হাজার ২৬২ জনকে। গতকাল দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে অক্সফোর্ড ছাড়াও সিনোফার্মের টিকা পেয়েছেন আট হাজার ৩১৬ জন এবং ফাইজারের টিকা পেয়েছেন ৯১৮ জন। সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট টিকা দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৮ ডোজ। এ ছাড়া টিকার জন্য গতকাল বিকেল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন মোট এক কোটি ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৬ জন।

এদিকে জাপানের উপহারের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৬ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ ডোজ টিকা আজ ঢাকা এসে পৌঁছাবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/03/1059564