৩ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:০০

ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে শতকোটি টাকা পাচার

ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট ও অ্যাপে অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে অনলাইনে বেটিংয়ের নামে জুয়া খেলা; লাইভ স্ট্রিমিংয়ের নামে অশ্লীলতা ছড়ানো এবং ডার্কনেটে নতুন ধরনের মাদক কেনা হচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে সরাসরি কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকায় এটি অবৈধ কি না তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অবৈধ কারবারিরা।

তবে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রচলিত চারটি আইনে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন ও অর্থপাচার আইনত অপরাধ। সম্প্রতি অন্তত ১০টি অভিযানের তদন্তে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে।

প্রচলিত আইনের এসব ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে, কয়েকটি অ্যাপের মাধ্যমে বিটকয়েন, ডায়মন্ড, বিন্স, জেমস, ইথেরিয়াম, রিপল, লাইটকয়েন ও ইউএসডিটি নামের ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি সংগ্রহ করছে। কখনো লাইভ ভিডিও দেখা; কখনো বেটিং খেলায় অংশ নেওয়া বা কখনো গ্রুপ চ্যাটসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটায় ডিজিটাল এই মুদ্রা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকিং চেইনের বাইরে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন হয় বলে এতে অবৈধ কাজের সুযোগ বেশি। এ কারণে বিভিন্ন দেশে বৈধ বা নমনীয় নীতি থাকলেও বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কঠোর অবস্থানে আছে প্রশাসন। এই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের নতুন পথ খুঁজছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক জনস্বার্থে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি (স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তি) জারি করে জানায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বরও বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। তবে গত ১৮ মে সিআইডিকে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে বলা হয়, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন স্বীকৃত না হলেও এটিকে সরাসরি অপরাধ বলার সুযোগ নেই মর্মে প্রতীয়মান হয়।’ এই চিঠিতে তিনটি আইনের ‘আওতায় অপরাধ হতে পারে’ বলে মন্তব্য করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই চিঠিতে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হলেও পরবর্তী বিজ্ঞপ্তিতে তা পরিষ্কার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিআইডির কর্মকর্তারা।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নিয়মিত মামলা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মতামত দিয়েছে সেটিতে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধতা দেয়নি। তারা বলেছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। তবে অন্য আইনে এটিকে অবৈধ বলা যেতে পারে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ২৫-বি (১) ধারা অনুযায়ী—যদি কোনো ব্যক্তি কোনো আইনের নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ ভঙ্গ করে অথবা কোনো আইন অনুসারে আদায়যোগ্য শুল্ক বা কর ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যায় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ এর ৮ ধারা অনুযায়ী এসব কারেন্সি অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসা অবৈধ। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭ ধারা অনুযায়ীও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের ফলে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ীও।

গত ১২ জুন ‘বিগো’ ও ‘লাইকি’ অ্যাপে লাইভ স্ট্রিমিং করে ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে মাসে শতকোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। চক্রটি লাইভ স্ট্রিমিংয়ের নামে তরুণ-তরুণীদের অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করে। এই ভিডিওতে প্রলুব্ধ করা হতো যুবক, বিশেষ করে নিঃসঙ্গ প্রবাসীদের। এস এম নাজমুল হক নামের একজন বিদেশি এজেন্সির মাধ্যমে ‘ডায়মন্ড’ ভার্চুয়াল মুদ্রা সরবরাহ করে। স্ট্রিমে ঢুকতে ডায়মন্ড লাগে।

গত ১৮ এপ্রিল একটি চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তারের পর ‘স্ট্রিমকার’ নামে অ্যাপে জুয়ার মাধ্যমে ‘বিন্স’ ও ‘জেমস’ ব্যবহার করে অর্থপাচারের তথ্য পায় পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। মামলার তদন্তে নেমে গত ৯ জুন সিলেট থেকে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির সাইবার পুলিশ।

পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, বেটিং সাইট বা অনলাইন জুয়ার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল করতে ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি এলএসডিসহ কিছু নতুন মাদকদ্রব্য বিদেশ থেকে পার্সেলে কেনায় ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করা হয়েছে।

১২ জানুয়ারি গাজীপুর থেকে রায়হান হোসেন নামের এক যুবককে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। এই যুবক বিটকয়েন বিক্রি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন। তাঁর ২৭১টি অ্যাকাউন্টে এক মাসে ৩৫ হাজার ডলার লেনদেন হয়েছিল। গত ২ মে রাজধানীর বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার ইসমাইল হোসেন ওরফে সুমন বেসিক বিজ মার্কেটিং নামের একটি আউটসোর্সিং কম্পানির আড়ালে প্রায় ১৫ লাখ ডলারের বিটকয়েন কারবার করেন। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সাতরাস্তা থেকে মাহমুদুর রহমান জুয়েল নামের আরেক যুবককে গ্রেপ্তার করে ডিবি। জুয়েল ‘বিটকয়েন’, ‘ইথিরিয়াম’, ‘ইউএসডিটি’ নামে ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচা করতেন। তিনি ‘ব্লক চেইন’, ‘বাইনান্স’ ও ‘কয়েন বেইস’ নামে তিনটি অ্যাপে বিটকয়েন কারবার করছিলেন বলে জানায় তদন্তকারী সূত্র।

সূত্র জানায়, ভিপিএনসহ কিছু অনুমোদনবিহীন গেটওয়ে ব্যবহার করে জুয়ার সাইটে ক্রিপ্টোকারেন্সির কারবার চলছে। বিটকয়েনের লেনদেনের কোনো রেকর্ড থাকে না। এ সুযোগ নিচ্ছে ডার্কনেটে মাদক বিক্রেতারাও। এর মাধ্যমে অর্থপাচার করছে কালো টাকার মালিকরা।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, সুন্দরী তরুণীদের দিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং করিয়ে সেখানে যোগ দিতে ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর জুয়া খেলায় প্রলুব্ধ করা হয়। ‘স্ট্রিমকার’ নামের অ্যাপে সংযুক্ত লক্ষাধিক বাংলাদেশি ব্যাংকিং, হুন্ডি, নেটেলার, স্ক্রিল ও বিদেশি একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ‘বিন্স’ কিনছে। বিগো ও লাইকির অ্যাপেও লক্ষাধিক ব্যক্তি ডায়মন্ড কিনেছে। এসব চক্র মাসে শতকোটি টাকা পাচার করছে। চক্রের দুজনের অ্যাকাউন্টেই ১৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ডিজিটাল ওয়ালেটে বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরে আর কোথাও নেই। তাদের গ্রেপ্তারের পর অর্থপাচারের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অবৈধ কারবারের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/08/03/1059573