৩ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:৫৮

নৌ ও সড়কপথে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

তৃতীয় দিনেও ঢাকামুখী মানুষের স্রোত

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে টানা তৃতীয় দিনেও (সোমবার) ঢাকামুখী মানুষের স্রোত দেখা গেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ পথে ভেঙে ভেঙে নানা দুর্ভোগের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় পৌঁছান। এ সময় পাটুরিয়া ফেরিঘাটসহ সড়ক, মহাসড়ক এবং নৌপথের চলাচলকারী যানগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বরাবরের মতো সবখানেই উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি।

শনি ও রোববার যারা ঢাকায় এবং আশপাশের এলাকায় আসতে পারেননি এমন মানুষ বেশি এসেছে গতকাল। যাত্রীরা বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন। ঢাকামুখী মানব স্রোতে শুধু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী নয়, নানা অজুহাতে অন্য পেশার মানুষও ঢাকায় প্রবেশ করেছে। আইন ভেঙে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস চলাচল করতেও দেখা গেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন নৌরুটে নির্ধারিত সময়ের পরেও চলেছে লঞ্চ।

সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কর্মস্থলমুখী যাত্রীরা কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করেই কর্মস্থলে ফেরার ঢল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটুরিয়া ফেরিঘাটে অব্যাহত ছিল। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে জরুরি সেবায় নিয়োজিত গাড়ি ছাড়া ফেরিযোগে অন্য সব যানবাহন ও যাত্রী পারাপার নিষিদ্ধ থাকলেও সেই বিধিনিষেধের বালাই নেই ঘাট এলাকায়।

দৌলতদিয়া থেকে পার হয়ে আসা মাগুরার রিয়াদ মাহমুদ জানান, কাজ করেন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় একটি রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরি কারখানায়। বাড়ি থেকে কাকডাকা ভোরে রওয়ানা হয়ে অনেকে কষ্ট ভেঙে ভেঙে ঘাটে আসতে সক্ষম হয়েছি। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ফেরিতে উঠতে রীতিমতো যুদ্ধ করে ফেরিতে উঠছি এবং এখন পাটুরিয়া ঘাটে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হই। পাটুরিয়া ঘাটে এসে যানবাহনের মহাসংকট দেখা দেয়। গাজীপুর পর্যন্ত ২০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা কিছু করার নেই। পাটুরিয়া ঘাটে আলমগীর হোসেন নামের এক প্রাইভেট কারের চালক জানান, ঘাটে তেমন গাড়ি নেই, সেজন্য এখন প্রচুর চাহিদা আর এ কারণেই ভাড়াটা একটু বেশি নিচ্ছি, ভাড়া বেশি না নিলে তো লোকসান হয়ে যাবে তার কারণ রাস্তায় বিভিন্ন জায়গা ম্যানেজ করে আমাদের চলতে হয়। পাটুরিয়া থেকে গাবতলী পর্যন্ত কত টাকা ভাড়া নিচ্ছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, গাবতলী প্রতি যাত্রীর জন্য ভাড়া ৭০০ টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন পারাপারের জন্য ৮টি ফেরি নিয়োজিত রয়েছে। যেহেতু পোশাক কারখানা খোলা সেজন্য বেশি সংখ্যক যাত্রী ফেরিতে উঠছেন। বাধ্য হয়ে তারা যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রীও পারাপার করছেন।

আরও দেখা গেছে, গার্মেন্টসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার যাত্রীদের নিয়ে সোমবার ঢাকার উদ্দেশে ভোলার বিভিন্ন ঘাট থেকে ছেড়ে গেছে ৫টি লঞ্চ। ভোরা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের চাপ ছিল খুবই কম। সোমবার সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ভোলার বিভিন্ন ঘাট থেকে লঞ্চগুলো ছেড়ে যায়। ভোলার খেয়াঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া এমভি বালিয়া লঞ্চের সুপারভাইজার আমিনুল ইসলাম বলেন, ভোলার খেয়াঘাট থেকে সকাল ৯টার দিকে প্রায় ২৫০ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চ ছাড়ে। আশা করি বিকাল সাড়ে ৩টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাবে। মাত্র ১২টি কেবিন ও একটি ভিআইপি কেবিন বুকিং হয়েছে। আর বাকি সব কেবিন ফাঁকা রয়েছে। বলেন, রোববারের চেয়ে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। লঞ্চের যাত্রীরা সবাই যাতে মাস্ক পরে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সেজন্য স্টাফরা কাজ করে যাচ্ছে।

আর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঢাকামুখী যাত্রী পরিবহণে নৌ ও সড়কপথে নানাভাবে বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করা হয়েছে। ভোর ৬টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন থাকলেও গতকাল দুপুর ১২টায় বরগুনার আমতলী থেকে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে এমভি ইয়াদ-১ জাহাজ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গেছে। এ লঞ্চের সুপারভাইজার মো. শামীম বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুসারে লঞ্চে যাত্রী বহন করছি। আমরা কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ছাড়তে চাইলেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ বিধিনিষেধ অমান্য করে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে উঠছে।

গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় সড়ক ও মহাসড়কে ঢাকামুখী যাত্রীদের অন্তহীন দুর্ভোগ মাড়াতে হয়েছে। গণপরিবহণের সংকটের সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে অটোরিকশা, রিকশা, লেগুনাচালকরা। তারা ১০ থেকে ১৫ টাকার ভাড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা আদায় করেছেন। বেশি ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন পরিবহণ শ্রমিকরা। এ প্রসঙ্গে মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রায় ১ ঘণ্টা পর সকাল ৯টার দিকে তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর এ মহাসড়কে অনুমোদিত যানবাহন চলাচল শুরু করে।

সিলেটে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের পরও বাসসহ অন্যান্য গণপরিবহণ চলাচল করেছে। এসব পরিবহণে চড়ে সিলেট থেকে ঢাকায় গেছে অনেক মানুষ। এছাড়া সিলেট শহর ছেড়ে যাওয়া অনেক মানুষ সিলেট শহরে ফিরেছে। এসব গণপরিবহণের যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। সিলেটের পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা ইসমাঈল হোসেন কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায়।

ঈদের ছুটি কাটাতে সিলেটে এসেছিলেন। বিধিনিষেধে সব ধরনের কারখানা ও যান চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতে পারেননি। রোববার থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ায় ফেরার পথ ধরতে হয় তাকে। তিনি আল-মোবারাকা বাসের টিকিট করেন ৭০০ টাকা দিয়ে। তবুও ফেরার বাহন পেয়ে খুব খুশি তিনি। বাস চলাচলের সময় আরও একটু বাড়ালে যাত্রীদের যাতায়াতে সুবিধা হতো বলে তিনি মনে করেন।

কাউন্টারগুলোতে কথা বলে জানা যায়, সকাল ৬টায় সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে বাসের যাত্রা শুরু হয়। বেলা পৌনে ২টায় আল-মোবারাকার শেষ বাসটিসহ মোট ৭টি বাস সিলেট ছেড়ে যায়। বেলা দেড়টায় মামুন পরিবহণেরও শেষ বাসটিসহ মোট ৫টি বাস যাত্রী নিয়ে সিলেট থেকে ছেড়ে যায়। রোববার রাতেও বেশ কয়েকটি বাস যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায় ঢাকার উদ্দেশে।

সোমবারও রাতে গাড়ি যাবে বলে যাত্রীদের সিট বুকিং দিতে দেখা গেছে। সরকার নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এ সময়ের পর আর কোনো বাস চলাচলের কথা না থাকলেও নিয়ম ভাঙতে দেখা গেছে। এসব গণপরিবহণ আবার সোজা পথে না গিয়ে লাউয়াই এলাকার বঙ্গবীর সড়ক ব্যবহার করে চন্ডীপুলের মহাসড়কে ওঠে। এছাড়া লকডাউনের শুরু থেকেই কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন রাতে ঢাকা যাচ্ছে মাইক্রোবাস (হাইয়েস)। যাত্রীদের জনপ্রতি গুনতে হয়েছে দেড় হাজার টাকা করে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল-মোবারাকা সিলেট কাউন্টারের একজন বলেন, যাত্রীদের চাপ বেশি ছিল। তাই আমরা নির্ধারিত সময়ের পরেও বাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। বিকল্প পথ ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে মামুন পরিবহণের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্ধারিত সময়ের পরে হুমায়ূন রশীদ চত্বর হয়ে গেলে পুলিশ ধরতে পারে। তাই বিকল্প পথ ব্যবহার করে যেতে হয়েছে।

সরেজমিন দক্ষিণ সুরমা বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, কদমতলী এলাকায় অনেকগুলো বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়। মামুন পরিবহণ ও আল-মোবারাকা ছাড়া বেশির ভাগ বাসই শনিবার চলাচল করেনি।

জানতে চাইলে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, সিএনজি অটোরিকশাচালকদের বেশি ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষকেও প্রতিবাদী হতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। এ রকম ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশকে অবগত করলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
সোমবার যাত্রীর চাপ কমে যাওয়ায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সোমবার দুপুরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিমুলিয়া নদীবন্দরের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক ও সহকারী বন্দর ও পরিবহণ কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন এ খবর নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সোমবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ রুটে ৫২টি লঞ্চ চলাচল করেছে। তবে যাত্রীর চাপ কমে যাওয়ায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়া চাপ কমলেও গতকাল ফেরিতে যান ও যাত্রী পারাপার হতে দেখা গেছে। সোমবার সকাল থেকে কর্মস্থলে ফেরাসহ নানা প্রয়োজনে বিধিনিষেধের মধ্যেও ঢাকার অভিমুখে লঞ্চ ও ফেরিযোগে পদ্মা পাড়ি দিতে দেখা যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শত শত যাত্রীকে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে গতকাল ৯টি ফেরি চলাচল রয়েছে। গত দুদিনের চেয়ে যাত্রী চাপ অনেকটাই কম।

গতকাল ভোলা থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী যাত্রীদের নিয়ে লঞ্চ ছাড়ার সর্বশেষ সময়সীমা সোমবার সকাল ৬টায় থাকলেও ইলিশা ঘাটে সকাল ১০টা পর্যন্ত নৌযান ছাড়ার সুযোগ দিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা। এমন সুযোগে ১০টি লঞ্চ ও সি-ট্রাক যাতায়াত করে। তবে ওইসব যানে যাতায়াতকারী যাত্রীদের ভিড় কম থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ যাত্রীর মুখে ছিল না মাস্ক। এমনকি কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানতেও দেখা যায়নি। ঘাট এলাকায় বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেলেও এ ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকাও দেখা যায়নি। এমন অবস্থার মধ্যে সকাল ৮টায় ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে ওয়াটারবাস গ্রীনলাইন, ১০ মিনিট পর ছাড়ে এমভি তাসরিফ-১ ও দুপুরে ছাড়ে চরফ্যাশন বেতুয়া থেকে আসা আরও দুটি লঞ্চ। এছাড়া লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরী ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায় সি-ট্রাক খিজির-৫, খিজির-৮, এসটি সুকান্ত বাবু, এসটি ভাষা শহীদ সালাম ও এমভি পারিজাত লঞ্চ। অপরদিকে ফেরি কিষানী, কুসুমকলি, কনকচাঁপা পরিবহণের পাশপাশি যাত্রী পারাপার করে থাকে।

প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ১ থেকে ৭ জুলাই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে তা বাড়িয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত করা হয়। পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনেই ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোরতম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সে হিসাবে কঠোরতম বিধিনিষেধের ১১তম দিন ছিল সোমবার।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/449476/