২ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১১:৪৮

ডেঙ্গু এবং সরকারের দরকার

সহজবোধ্য হলেও শিরোনামের কথা এবং তার অর্থকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। ছোট্ট কথাটুকুর মতো এর উত্তরও যথেষ্ট গুরুতর। আর গুরুতর বলেই শুরুতে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। এরকম সর্বশেষ একটি প্রধান তথ্য হলো, কোভিড-১৯ বা মহামারি করোনার কারণে বিগত এক-দেড় বছরে ‘রেকর্ড’ কথাটার সঙ্গে দেশের অশিক্ষিতজনেরাও পরিচিত হয়ে উঠেছেন। গণমাধ্যম এবং নামধারী সাংবাদিকদের বদৌলতে তারা ‘সর্বোচ্চ’ এবং ‘সর্বাধিক’-এর মধ্যকার পার্থক্য যেমন ভুলে গেছেন, তেমনি তাদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। আজকাল আর এক-দেড়শ’ এমনকি আড়াইশ’র বেশি এবং তিনশ’র কাছাকাছি সংখ্যক মৃত্যুও তাদের আন্দোলিত করে না। মনে হয় যেন এটাই স্বাভাবিক!

করোনার ক্ষেত্রে এমন অবস্থার কারণেই ডেঙ্গুও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ বেশ কিছুদিন ধরে ডেঙ্গু পরিস্থিতিরও আশংকাজনক অবনতি ঘটে চলেছে। যেমন গতকাল, ৩১ জুলাই জাতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, জুলাই মাসে রেকর্ড করেছে ডেঙ্গু। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের সংখ্যা ছিল ৩৭২ জন। অন্যদিকে সদ্য সমাপ্ত জুলাই মাসেই আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৮৬ জনে। আক্রান্তজনেরা যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না- সে তথ্যটিও রয়েছে প্রকাশিত রিপোর্টে।

রিপোর্টে অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা হয়েছে। এটা অবশ্য মোটেও আর নতুন খবর নয় যে, রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের সীমাহীন ও চরম দৌরাত্ম্য চলছে। মূলত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘নগদ নারায়ণ’ লেনদেনের বিনিময়ে ব্যবসায়ী নামের একদল ধান্দাবাজ টাউটের সমন্বয়ে এক-একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। সিন্ডিকেটগুলোর কোন গোষ্ঠী ব্যবসা-বাণিজ্যের ঠিক কোন খাতে তৎপরতা চালাবে- সেসব বিষয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তারা আবার ‘সততার সঙ্গে’ কিছু নীতিও মেনে চলে। কোনো গোষ্ঠী অন্যের ব্যবসায় নাক গলায় না।

দেশে সকল পণ্যের বাজারই সিন্ডিকেটগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখনও রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল দেয়া, ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করা এবং মাদকের চোরাচালান থেকে মাদকের অবৈধ ব্যবসা পর্যন্ত সবকিছুও পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেটগুলো। চাল-ডাল-আটা ও সবজি হোক আর হোক মাছ-মাংস কিংবা সয়াবিন, শিশু খাদ্য বা ওষুধ- কোনটার দাম কত হবে, বাজারে কোন পণ্যের সরবরাহ কি পরমাণ হবে- এসবই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেটগুলো। এজন্যই সময়ে সময়ে সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা ও ধমক দিলেও কোনো পণ্যেরই দাম কমে না।
বর্তমান সরকারের প্রায় সাড়ে ১২ বছরে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তো বটেই, শিক্ষা, চিকিৎসা, সড়ক ও যোগাযোগ থেকে শুরু করে এমন কোনো একটি ক্ষেত্রের নাম বলা যাবে না, যেখানে কোনো না কোনো গোষ্ঠীর তথা সিন্ডিকেটের রাজত্ব কায়েম না হয়েছে। এসব সিন্ডিকেটই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ একটি তথ্য হিসেবে এসেছে ডেঙ্গুর ওষুধের ব্যবসা। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকাসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশেও যখন ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে চলেছে এবং সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই যখন প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তেমন এক কঠিন সময়েও ডেঙ্গুর প্রতিষেধক ওষুধের আমদানি বিশেষ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কোনো এক কোম্পানির আড়ালে ওষুধ আমদানির সকল তৎপরতা চালাচ্ছে বিশেষ একটি গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটি শুধু আমদানির কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রণ করছে না, ওষুধের বাজারও দখল করে নিয়েছে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, কৃষিকাজে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহার্য বিভিন্ন রোগ-বালাইনাশক ওষুধের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের অক্টোবরে সরকার কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনা জারি করেছিল। সে নির্দেশনার ভিত্তিতে এবং এর বিভিন্ন ধারা-উপধারার অপব্যাখ্যার সুযোগ নিয়ে এতদিন দেশের দুটি মাত্র ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সকল ধরনের রোগ-বালাইনাশক ওষুধ আমদানি ও বাজারজাত করার সুবিধা ভোগ করে এসেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি নিজেরাও ওষুধ তৈরি করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটার পর পর্যালোচনা ও পরীক্ষায় দেখা গেছে, দুটির মধ্যে একটি কোম্পানির ওষুধ শুধু ডেঙ্গু প্রতিরোধেই ব্যর্থ হয়নি, এর বিভিন্ন ওষুধ অকার্যকরও। বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর জনমতের চাপে সরকার ওই কোম্পানির সকল ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো ব্যাপার-স্যাপার! সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ওষুধের সব কর্তৃত্ব চলে গেছে একটি মাত্র কোম্পানির দখলে। কোম্পানিটি পরিস্থিতির এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারও করে চলেছে যথেচ্ছভাবে।
অন্যদিকে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন এমনকি সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনের কর্তা ব্যক্তিরাও। যেমন দক্ষিণের মেয়র প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে দুটি মাত্র কোম্পানিই সব ওষুধ আমদানি করবে কেন? তিনি আরো বলেছেন, অন্য সব কোম্পানিকে বাদ দিয়ে দুটি কোম্পানির কাছে সব কর্তৃত্ব রয়েছে বলেই একদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে জনগণের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনকে। সিটি মেয়র প্রসঙ্গক্রমে কোম্পানি দুটির একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে ওষুধ আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
দাবিটি বাস্তবসম্মত হলেও সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য অনেক সময় দরকার বলেই দক্ষিণের মেয়রসহ কর্তা ব্যক্তিরা কেন এতদিন পর- তাও ডেঙ্গু প্রায় মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর সোচ্চার হয়েছেন সে প্রশ্ন যেমন উঠেছে তেমনি দূষিত পরিবেশের জন্যও দায় চাপানো হচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনের ওপর। বলা হচ্ছে, কেবলই আমদানির বিষয়টিকে প্রাধান্যে এনে মেয়রসহ কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যর্থতা ও দায়দায়িত্ব আড়াল করতে পারেন না। মানুষের জীবনহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির জন্য তারাও সমানভাবে দায়ী।
এদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে আরো জানা গেছে, আমদানি স্তিমিত হওয়ার কারণে ওষুধ স্বল্পতার যুক্তি ও অজুহাত দেখিয়ে বর্তমানে যেসব ওষুধ ছেটানো হচ্ছে সেগুলো আইসিডিডিআরবি’র পরীক্ষায় সম্পূর্ণ অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় মহামারির মধ্যেও অকার্যকর ওষুধই ছিটিয়ে চলেছে দুই সিটি করপোরেশন। ওদিকে যেহেতু আমদানির জন্য সময় দরকার সেহেতু সব জেনেও সরকার সুকৌশলে নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে। একজন মন্ত্রী অবশ্য ‘প্রয়োজনে বিমানযোগে ওষুধ আমদানির’ হাস্যকর ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। একই কারণে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ তো কমছেই না, ডেঙ্গু রোগের বিস্তারও আগের মতোই ঘটে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশেও।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী একটি রোগের বিষয়ে অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যক্রমকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সুযোগ নেই। দুই সিটি করপোরেশনের ওপর দায় চাপিয়ে তাই সরকারও রেহাই পেতে পারে না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে, ‘তাহলে আর সরকারের দরকার কি?’ দেশে কোনো সরকার আছে কি না এবং জনগণ আসলেও সেই সরকারের কোনো দরকার বোধ করে কি না- এ ধরনের প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে জরুরিভিত্তিতে মশানাশক ওষুধ আমদানি করা এবং সারাদেশে সেগুলো ছড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ওষুধ আমদানির ব্যাপারেও সরকারকে তার নীতিতে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দু’-একটি মাত্র পছন্দের কোম্পানিকে দেয়ার পরিবর্তে সকল কোম্পানিকেই ওষুধ আমদানির সুযোগ দিতে হবে, যাতে কোনো সিন্ডিকেটের পক্ষে সম্পূর্ণ বাজার দখলে নেয়া এবং জাতিকে জিম্মি বানানো সম্ভব না হয়। বলা দরকার, ঘুষ-দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে এবং ‘নগদ নারায়ণের’ লোভ সামাল দিয়ে আমদানিকৃত সকল ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভবিষ্যতে আর কখনো ডেঙ্গু মহামারির আকার ধারণ করতে পারবে না। বৃহত্তর জনস্বার্থেই সরকারের উচিত সে লক্ষ্যে অবিলম্বে তৎপর হয়ে ওঠা- অবশ্য সরকার যদি তার ‘দরকার আছে’ কথাটা প্রমাণ করতে চায়!

https://dailysangram.com/post/460276