১ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১১:৪৩

করোনায় আইনজীবী মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

মাহবুবে আলম, আব্দুল মতিন খসরু, নজরুল ইসলামসহ প্রায় ৫০ আইনজীবীর মৃত্যু; ৫৯ বিচারক ও ১৪৩ কর্মচারী আক্রান্ত, ২ বিচারকের মৃত্যু

প্রতিদিনই বাড়ছে ঘাতক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আইনাঙ্গনেও আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। করোনা কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি আব্দুল মতিন খসরুকে। করোনাকালেই আইনাঙ্গন হারিয়েছে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে। বহু গুণী আইনজীবীর জীবন অকালে ঝরে গেছে করোনায়। যার সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও এই সংখ্যা প্রায় ৫০ জনের অধিক হতে পারে বলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জানিয়েছেন। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য আইনজীবী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। করোনায় এ পর্যন্ত দুইজন বিচারক মৃত্যুবরণ করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশের অধস্তন আদালতের ৫৯ জন বিচারক করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। আর করোনায় আক্রান্ত ১৪৩ জন সহায়ক কর্মচারী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সারা দেশের অধস্তন আদালতের এ পর্যন্ত মোট ৩২৫ জন বিচারক এবং ৬৪০ জন সহায়ক কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম : রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দায়িত্বে থাকা অবস্থায় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি মাহবুবে আলম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকে টানা ১২ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেই সাথে পদাধিকার বলে তিনি আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
আব্দুল মতিন খসরু : সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সভাপতির চেয়ারে বসার আগেই গত ১৪ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু গত ১৫ মার্চ সংসদ সচিবালয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। ১৬ মার্চ সকালে তার রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসে। ওই দিনই তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : করোনাকালেই গত বছরের ২৪ অক্টোবর দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ইন্তেকাল করেন। রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে কাজ করেছেন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের দুই প্রধান নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য আইনি লড়াই করেন তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার জীবনের উপার্জিত অর্থের প্রায় সবই ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ : প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গত ১৬ মার্চ ইন্তেকাল করেন। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। গত ১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য মওদুদ আহমদ সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। ফুসফুসে পানি জমার কারণে অবস্থার অবনতি হলে গত ৯ মার্চ তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। মওদুদ আহমদ দেশের এক বর্ণাঢ্য রাজনীতিক। তিনি আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম : করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ লইয়ার্স কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম গত ১৫ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমান ইন্তেকাল করেন।
ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক জহির আহমেদ : করোনায় আক্রান্ত হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক সদস্য বিচারপতি এ কে এম জহির আহমেদ (৬৮) গত ১৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন তিনি।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া আক্তার : গত ২৮ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঝালকাঠি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া আক্তার (২৯) ইন্তেকাল করেছেন।
প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম : করোনাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম গত ২৭ জুন রাজধানীর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
সিনিয়র আইনজীবী জিয়াউর রহমান খান : গত ২৪ এপ্রিল রাতে সিনিয়র আইনজীবী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জিয়াউর রহমান খান ইন্তেকাল করেন। তার বাবা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। ২৫ এপ্রিল সকালে শেখ ইউনুস আলী করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ। একই দিন বিকেলে আইনজীবী নাজমুল হাসান (৭৮) মৃত্যুবরণ করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আলী হায়দার কিরণ মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার আব্দুল মান্নান (৭০) মৃত্যুবরণ করেন।
এছাড়া গত ৫ এপ্রিল আইনজীবী রশিদ আহমেদ (৫১) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন আইনজীবী মমতাজ আলী ভূঁইয়া (৭০)। ১০ এপ্রিল আইনজীবী মো: ওবায়দুল্লাহ (জাকির) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ১৩ এপ্রিল মারা যান আইনজীবী সৈয়দ মোকাদ্দাস আলী। ১৫ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন আইনজীবী মনজুর কাদের। ১৬ এপ্রিল মারা যান রেজিনা চৌধুরী জেনি (৫৭)। ২৩ এপ্রিল সকালে মারা যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী লিও সাহা কেনেডি। এছাড়া বহু আইনজীবীর জীবন কেড়ে নিয়েছে করোনা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/598444/