১ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১১:৪১

ফাইজার অক্সফোর্ড মডার্না ও রুশ টিকা আনার জন্য চেষ্টা হচ্ছে না কেন?

ঠিক করেছি, আজ আফগানিস্তান নিয়ে লিখবো। গত সপ্তাহেও লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই করোনার এমন সব খবর এসে পড়ছে যে তখন আর সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বৃহস্পতিবার ২৯ জুলাই লিখতে বসে করোনার টিকা দান সম্পর্কে দুটি কনফ্লিকটিং রিপোর্ট পেলাম। একটিতে বলা হয়েছে যে করোনার টিকা নেয়ার সর্বনিম্ন বয়স সীমা হতে যাচ্ছে ১৮। ১৮ ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের টিকার নিবন্ধন শুরু হবে ৮ আগস্ট থেকে। এই সংবাদের উৎস হলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ৮ আগস্ট থেকে যার বয়স ১৮ বা তার বেশী হবে, তাদের নিবন্ধন শুরু হবে।

একই দিন একই সময়ে একই পত্রিকায় একই মন্ত্রী বলেছেন যে, বৃহস্পতিবার ২৯ জুলাই টিকা নিবন্ধন করতে সরকারি সুরক্ষা এ্যাপে ২৫ বছরের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ২৫ বছর বয়সীদের নিবন্ধনও ৮ আগস্ট থেকে শুরু করা হবে। এর আগে বয়সসীমা আরো দুইবার নামিয়ে আনা হয়। প্রথমে ৪০ বছর থেকে ৩৫ বছর। তারপর ৩৫ বছর থেকে ৩০ বছর। এখন আবার ৩০ বছর থেকে ২৫ বছর। এপর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু ২৫ বছরের পর ১৮ বছরে নামিয়ে আনার যে কথা বলা হয়েছে সেটা তো একজন প্রতিমন্ত্রীর, যিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে জড়িত নন। এটি কোনো সরকারি ঘোষণাও নয়। যদি বয়সসীমা ১৮ বছরে নামিয়ে আনা হয়ে থাকে তবে সেটি অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু সরকারিভাবে ঘোষণাটি না আসলে মানুষ কোন দিকে যাবেন?

অপর এক খবরে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন বাড়ানো হয়েছে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। এছাড়া প্রদেশটিতে রাত্রিকালীন সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। প্রদেশটির মুখ্য সচিব কারফিউ কড়াকড়িভাবে বলবৎ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি এবং ক্যানবেরায় কথা বললাম। ক্যানবেরা অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী। সেখানে তেমন একটা সংক্রমণ নাই। তাই সেখানে লকডাউন নাই। কিন্তু টিকাদান অভিযান চলছে। অষ্ট্রেলিয়া লাইসেন্স নিয়ে অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকা বানায়। তাদের স্টকে মজুদ রয়েছে ৬ কোটি ডোজ এ্যাস্ট্রাজেনেকা।

কিন্তু অষ্ট্রেলিয়া আমেরিকা থেকে ফাইজারের টিকা এনেছে। ক্যানবেরা, সিডনি, ব্রিসবেন এবং পার্থে ফাইজারের টিকা দেওয়া হচ্ছে। আমার ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার ফাইজারের টিকা নিয়েছে। সিডনিতে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় প্রকোপ বেশী বলে প্রতি তিনদিন পর সিডনিবাসীদের করোনা টেস্ট করার জন্য বলা হয়েছে। ঐদেশে করোনা টেস্ট ফ্রি। কোনো পয়সা লাগে না। সিডনিতে গত ১৫ দিন ধরে লকডাউন চলছিল। ২৮ জুলাই ঘোষণা করা হয়েছে যে এই লকডাউন পুরা আগস্ট মাস চলবে। সেখানে লকডাউন মানে লকডাউন। কঠোর লকডাউন। বিন্দুমাত্র শিথিলতা নাই। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্যের কথা বলে সেখানে লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি বিন্দুমাত্র শিথিল করা হয় না। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

॥দুই॥
ফাইজার বায়োএনটেক ঘোষণা করেছে যে বিগত ৩ মাস তারা ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের টিকা বিক্রয় করেছে। এই বছরের শেষে তাদের বিক্রয় লব্ধ আয় হবে ৩৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ টাকায় ২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। যারা এবছরের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকার টিকা বিক্রি করতে যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে কি আমরা কয়েক মিলিয়ন বা ১/২ বিলিয়ন মূল্যের টিকা কিনতে পারি না? আমরা শুধুমাত্র চীনা টিকার ওপর ভরসা করে আছি কেন? পত্রিকান্তরে আজ (শনিবার ৩১ জুলাই) দেখলাম, এ্যাস্ট্রাজেনেকা এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী ৩১ কোটি ৯০ লক্ষ ডোজ টিকা বিক্রি করেছে। আমরা এ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপর ভরসা করেছিলাম। দেড় কোটি ডোজের টাকা অগ্রিম দিয়েছিলাম। মাত্র ৭০ লক্ষ ডোজ দিয়েছে। বাঁকী ৮০ লাখ টিকা না দিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। আমরা নগদ টাকায় এ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য অন্যত্র চেষ্টা করলাম না কেন? এ পর্যন্ত অক্সফোর্ড প্রায় ৩২ কোটি ডোজ এ্যাস্ট্রাজেনেকা বিক্রয় করেছে। সেখান থেকে কি আমরা দুই চার কোটি ডোজ টিকার চেষ্টা করতে পারতাম না?
আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘হুর’ অধীন কোভ্যাক্সের খয়রাতি টিকার জন্য দিনের পর দিন বসে থাকি কেন? ১৫ লক্ষ মানুষ এ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ দিয়ে বসে আছে। জাপান কবে কোভ্যাক্সের অধীনে ২৯ লাখ টিকা দেবে আর সেই টিকা ঐ ১৫ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে- সেই আশায় বসে থেকে ঐ ১৫ লাখ মানুষের কি ক্ষতি করা হচ্ছে না?

১ লক্ষ ৬ হাজার ফাইজারের টিকা এসেছিল। সেটিও কোভ্যাক্সের খয়রাতি টিকা। অথচ একটু আগেই উল্লেখ করেছি যে ফাইজার চলতি বছরে ৩ কোটি লাখ টাকার টিকা বিক্রি করবে। গতকালের একটি ইংরেজি পত্রিকায় দেখলাম যে বাংলাদেশ টিকা কেনার জন্য ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পাচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে। এছাড়াও আরও এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য পাওয়ার আশা করছে অন্যান্য বিদেশি সাহায্য সংস্থা থেকে। সব মিলিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পাচ্ছে। সেই বিশাল অর্থ ব্যয় হবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার কাজে। আমি লক্ষ্য করেছি, মানুষ চীনের সিনোফার্মের টিকা চায় না। যারা সিনোফার্মের টিকা দিচ্ছে, তারা দিচ্ছে অগত্যা মধুসূদন হিসেবে। টিকা দিতে গিয়ে সেন্টারে তারা জিজ্ঞাসা করে, কোন টিকা দিচ্ছেন? যদি শুনে সিনোফার্ম, তাহলে জানতে চায়, মডার্নার টিকা দেবেন না? উত্তর, এখন তো নাই। পেলেও অনেক দেরী হবে। তখন ভগ্ন মনোরথ হয়ে চীনা টিকাই নেয়।
বগুড়ার দু’তিনজন সাধারণ মানুষ ফোনে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন রাশিয়ার টিকা কোথায় পাবো? আমি বলেছি, রাশিয়ার টিকা তো এখনো আসেনি। এটাই হল বাস্তব। মানুষ প্রথম ফাইজারের টিকা চায়। না হলে আমেরিকার মডার্না বা অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকা। সেটিও না হলে রাশিয়ার স্পুটনিক। অথচ এই ৪ টি কোম্পানির মধ্যে ফাইজার এবং মডার্নার যে টিকা এসেছিল বা এসেছে সেটিও কোভ্যাক্সের খয়রাতি টিকা। ভারতে উৎপাদিত এ্যাস্ট্রাজেনেকা, যেটা কোভিশিল্ড নামে পরিচিত, সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জাপান থেকে যে ২৯ লাখ ডোজ এ্যাস্ট্রাজেনেকা আসার কথা সেটিও কোভ্যাক্সের খয়রাতি টিকা। তাহলে সরকার ফাইজার, মডার্না বা এ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা কেনার কি কোনো চেষ্টা করেনি? করলে কি করেছে?

॥তিন॥
ভারত নাকি বাংলাদেশের জানি দোস্ত। রাশিয়ার সাথে তার বন্ধুত্ব ৭০ বছরের। সেই ভারত রাশিয়া থেকে কোটি ডোজ স্পুটনিক এনেছে এবং ভারতীয়দেরকে সেই টিকা দিয়েছেও। এছাড়াও তারা আমেরিকা থেকে কোটি কোটি ডোজ টিকা এনেছে। সেই জানি দোস্ত ভারত নিজে টিকা দেওয়ার ওয়াদা ভঙ্গ করলো। সে ক্ষেত্রে তারা কি বাংলাদেশের টিকা কেনার ক্ষেত্রে আমেরিকা বা রাশিয়ার কাছে তার ‘গুড অফিস’ ইউজ করতে পারল না? কেমন বন্ধু তারা বাংলাদেশের? শুধু নেওয়ার বেলা আছে, দেওয়ার বেলায় নাই?

ঐদিকে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত মেডিকেল সামগ্রীকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে সরকারের এত অনীহা কেন? বুয়েটের একদল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্মিলিত উদ্যোগে ‘অক্সিজেট’ নামক যন্ত্র সীমিত আকারে অক্সিজেন উৎপাদন করতে সক্ষম। দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার পর যখন অক্সিজেনের অভাবে দেশের চারিদিক থেকে মৃত্যুর সংবাদ আসছে, তখন সরকারের চৈতন্যোদয় হয়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেন ব্যবহারে যে বিপুল ব্যয় হয় সেই তুলনায় অক্সিজেট থেকে উৎপাদিত অক্সিজেন সাশ্রয়ী হবে। যন্ত্রটির উদ্ভাবকরা বলেছেন, এই যন্ত্রের মাধ্যমে সাধারণ বেডেই রোগী রেখে রোগীকে ৬০ লিটার পর্যন্ত উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দেয়া সম্ভব। দেশবাসী আশা করেন যে সরকার অক্সিজেট প্রকল্পকে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষতা দাান করবেন।

শেষ করার আগে একটি কথা। করোনা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণার অন্ত নেই। এক ডোজ টিকা, দুই ডোজ টিকা, বুস্টার ডোজ ইত্যাদি কত গবেষণা। কিন্তু একবারও আমরা ভাবিনা যে পৃথিবীতে হেন দেশ নাই, যেখানে করোনা ছোবল না হেনেছে। বিগত এক সহস্রাব্দে যত মহামারি এসেছে সেগুলো পৃথিবীর সবগুলো দেশে একসাথে আঘাত করেনি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার হুকুম ছাড়া এটা সম্ভব নয়। তাই দেখছি, পৃথিবীর কোনো দেশে এটির চতুর্থ ঢেউ আঘাত করেছে। আবার আল্লাহ্র ইচ্ছাতেই এ রোগ যাবে। এজন্য আবশ্যকীয় করণীয় হলো, যার যার অবস্থান থেকে সকল প্রকার গুনাহ্ ও অন্যায় কাজ পরিহার করে তওবা করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে। অমুসলিমরা না হোক, অন্তত সমগ্র মুসলিম জাহান যদি এক সাথে একটি সময়ে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করে, তাহলে পরিত্রাণ মিলতেও পারে। কারণ আল্লাহ্ই একমাত্র সমস্ত ক্ষমতার মালিক। আফগানিস্তানের ওপর আজ আর লেখা হলো না। এজন্য দুঃখিত।

https://dailysangram.com/post/460166