১২ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৮:২৪

তিস্তা তীরে ভাঙন

মানচিত্র থেকে হারাতে বসেছে চর গাবুরা পানিবন্দি কয়েক হাজার মানুষ তীব্র পানি ও খাবার সঙ্কট

করালগ্রাসী তিস্তা নদীর পানি কোথাও বেড়েছে, আবার কমেছে কয়েক স্থানে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি ও কমার মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ ভাঙন ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি লোকজন চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে পড়েছেন। খাদ্যের অভাবে পানিবন্দি পরিবারগুলো চরম দুর্দশার মধ্যে আছেন। একদিকে লকডাউন, অপরদিকে বন্যা, দুই মিলিয়ে কাজ হারানো পরিবারগুলোর মধ্যে অবিলম্বে ত্রাণের ব্যবস্থা নেয়া না হলে খাদ্যাভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়বে নারী ও শিশুরা।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে বাঁচতে ভারতীয় গজলডোবা ব্যারেজের সকল গেট একসঙ্গে খুলে দেয়ায় তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যায়। গত বুধবার থেকে আকস্মিকভাবে বাড়তে শুরু করে এবং শুক্রবার দুপুরে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এতে করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুরসহ গাইবান্ধা জেলার নদী তীরবর্তী এলাকা এবং বিভিন্ন চরাঞ্চলসহ নিম এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষজন গবাদিপশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠেন। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়। ব্যারেজ রক্ষায় ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেন কর্তৃপক্ষ।

আকস্মিকভাবে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার গড্ডিমারী, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের চৌরাহা, দক্ষিণবালাপাড়া, কুটিরপাড়, চরগোবরধন, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর ও গোকুণ্ডা ইউনিয়ন, নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ২৫টি চরের প্রায় ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, উজানের ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় ডাউয়াবাড়ি এলাকার ডানতীর প্রধান বাঁধ হুমকির মুখে পড়ে। বাঁধ রক্ষায় সেখানে বালির বস্তা, কাঠের ও বাঁশের পাইলিং করা হচ্ছে।
ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, এক রাতেই পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, ঝিঞ্জির পাড়া বেশকিছু গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। সেখানকার স্বেচ্ছাশ্রম বাঁধটি চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এই বাঁধটি ভেঙে গেলে চর খড়িবাড়ি মৌজার ২ হাজার পরিবারের বাড়িতে পানি ঢুকে পড়বে।

এছাড়া, ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী ও ঝুনাগাছ, কিছামত ছাতনাই, ঝাড় শিঙ্গেশ্বর, চর খড়িবাড়ি, পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, ছোটখাতা বাইশ পুকুর, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেখানকার মানুষজন গরু ছাগল নিয়ে নিরাপদে সরে গেছে।

এদিকে, তিস্তা নদীর পানি আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া এবং পীরগাছা উপজেলার প্রায় ১৩টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। পানি বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়।

আকস্মিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলসহ নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ৮ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েন। উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের পূর্ব বিনবিনা চর হতে লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী সংযোগ বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় বাগেরহাট বাজার এলাকাসহ আশ্রয়ন প্রকল্পে পানি ঢুকে পড়ে। নদীর তীব্র স্রোতে বিনবিনার চরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নির্মিত বাঁধটি ভেঙে পূর্ব বিনবিনার চরের মসজিদটি বিলীন হয়ে যায়। লক্ষীটারীর কেল্লারপাড় চরে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত উপবাঁধটিও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ইতোমধ্যে কোলকোন্দ ইউনিয়নের পূর্ব বিনবিনা ও পশ্চিম ইচলীর ১৭টি পরিবারের ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি, শংকরদহ, বাগেরহাট আশ্রয়ন, পূর্ব ইচলির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, মটুকপুর, চিলাখাল, খলাইরচরসহ নিম্ন এলাকার ৩ হাজার, নোহালীর মিনার বাজার, কচুয়াচর, বৈরাতী বাঁধের ধার, চর নোহালী, বাগডহরা চরের ২শ, মর্নেয়া ইউনিয়নের মর্নেয়াচর, তালপট্টি, আলাল চর, নরসিং চর, গজঘন্টা ইউনিয়নের কালির চর, ছালাপাক, গাউছিয়া বাজার, জয়দেব, মইশাসুর, রামদেব চরসহ আলমবিদিত ও গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের তিস্তা বেষ্টিত নিম্ন এলাকার ১শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে পীরগাছা উপজেলার কোলাহল মুখর দক্ষিণ চর গাবুরা গ্রামটি আজ বিলীন হতে চলেছে। ইতিমধ্যে এই গ্রামের সবকিছুই গ্রাস করে নিয়েছে করাল গ্রাসী তিস্তা। আর মাত্র ৪টি পরিবারের বসত-ভিটা গেলেই মানচিত্র থেকে মিশে যাবে পীরগাছা উপজেলার দক্ষিণ চর গাবুরা গ্রামটি। চরম হুমকির মুখে পড়ে আছে এই গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চর দক্ষিণ গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি শেষ রক্ষায় চলছে ব্যাপক তোড়জোর।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, নদী থেকে মাত্র ১৫ মিটার দূরে এ স্কুলটি শেষ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ, এলাকাবাসী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। দিনে-রাতে ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ওই গ্রামের ৫০টি বসতবাড়ি। ভাঙনের ফলে এসব বাড়ির লোকজন এখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/398199/