১২ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৮:১৪

দরিদ্রদের প্রকল্পে সাড়ে ১৫ শতাংশ সদস্যই সচ্ছল

আমার বাড়ি আমার খামার

অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছাড়ছে না দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে। আর এসব কারণে সরকারের সদিচ্ছাগুলো সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর অসৎ লোকবলের কারণেই উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধা বেশির ভাগ মানুষ পাচ্ছে না। গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ১০ উদ্যোগের আশ্রয়ণ প্রকল্পের পর আরো একটিও প্রশ্নবিদ্ধ। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে উপকারভোগী নির্বাচনেও স্বজনপ্রীতি, ভোটের হিসাব ও রাজনৈতিক প্রভাবে নীতিমালাকে তোয়াক্কা করা হয়নি। ফলে দরিদ্রদের জন্য নেয়া প্রকল্পে সাড়ে ১৫ শতাংশ সদস্যই সচ্ছল পরিবারের। অন্য দিকে প্রকল্প গ্রহণে বেজ লাইন সার্ভে হয়নি। রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ জনবলকাঠামো ও দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা। সর্বোপরি সমিতির সভাপতিসহ শীর্ষদের পেছনেই ব্যয় ২৮৫ কোটি টাকা বলে খরচের হিসাব ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্প পরিচালক বলছেন, আইএমইডির স্যাম্পলিং জরিপটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৫৬ লাখের বেশি সদস্যের মধ্য থেকে মাত্র কয়েক শ’ জনকে নিয়ে করা হয়েছে। এখানে খণ্ডচিত্র এসেছে, যা আমরা আইএমইডিকে মিটিংএ বলেছি।
জানা গেছে, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে এক নম্বর উদ্যোগ, যা শুধু দরিদ্র মানুষের জন্য নিবেদিত। একটি বাড়ি একটি খামার নামে এই প্রকল্পটি এক হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৯ সালের নভেম্বরে একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ পাঁচ বছরের জন্য প্রকল্পটি। মূল উদ্যোগে মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। তবে বাস্তবায়ন করছে মোট আটটি সংস্থা। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলার চার হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন ও ৩২৭টি পৌরসভায় এই প্রকল্পের কার্যক্রম। কিন্তু প্রকল্পটি ১২ বছর ধরে চলছে। আর সংশোধন হয়েছে চারবার। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ প্রথম সংশোধনে ব্যয় বাড়িয়ে এক হাজার ৪৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকায় অনুমোদন দেয় একনেক। তবে মেয়াদ এক বছর কমিয়ে ২০১৩ সালের জুন করা হয়। দ্বিতীয় সংশোধন আনা হয় ঠিক দু’বছর পর। ২০১৩ সালের জুলাইতে ব্যয় আরো বাড়িয়ে তিন হাজার ১৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং মেয়াদ আরো তিন বছর বৃদ্ধি করে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। চলছে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি। তৃতীয় দফায় সংশোধন করে খরচ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরের একনেকে প্রকল্পের খরচ একলাফে আট হাজার ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। আর বাস্তবায়নের সময় চার বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। এরপর চতুর্থ সংশোধন করে খরচ কিছুটা কমানো হয়। সর্বশেষ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এর ব্যয় সাত হাজার ৮৮৫ কোটি ২৫ লাখ টাকায় অনুমোদিত হয়। আর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ ১২ বছর।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলোÑ গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন, সমিতির জন্য সদস্য নির্বাচন করা, ঋণ বিতরণ, কিস্তি সংগ্রহ, কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠা, আয়বর্ধক কাজের প্রশিক্ষণ প্রদান, অনলাইন মার্কেট চ্যানেল তৈরি, উপজেলায় সমবায় বাজার প্রতিষ্ঠা এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের নিজস্ব ভবন তৈরি করা ইত্যাদি।
প্রকল্পের দুর্বলতা তুলে ধরে আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানদণ্ড বা নীতিমালা অনুসরণ না করা। এ ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা গোটা প্রকল্প কাজে বিঘœ সৃষ্টি করে। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে উপকারভোগী নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। উপজেলাপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি রয়েছে। সেই কমিটি গ্রামপর্যায়ে উপকারভোগী নির্বাচন করবে। মাঠপর্যায়ের তথ্যানুযায়ী, ওই নীতিমালা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করে অনেক স্থানেই উপকারভোগী বাছাই করা হয়নি। এখানে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে আলাপ করে এটা নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে নীতিমালাবহির্ভূত অনেক সচ্ছল ব্যক্তি সমিতিভুক্ত হয়েছে। যেখানে ৬০ জনের সমিতিতে ৯-১০ জনই সচ্ছল ব্যক্তি। সাড়ে ১৫ শতাংশ সদস্যই হলো সচ্ছল। যারা উপকারভোগী হওয়ার শর্ত পূরণ করে না। যোগ্য পরিবারের সদস্যরা বাদ পড়েছে।
আইএমইডি প্রতিবেদনের তথ্য হলো, মাঠপর্যায়ে উপকারভোগী লোকজন বলছে, ভোট, ভোটের চিন্তা, আত্মীয়তার সম্পর্ক, বাছাই কমিটির পক্ষপাতিত্বÑ এসব কারণে উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। আরো আছে অপর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা। এ ছাড়া সময় মতো কিস্তির টাকা পরিশোধ না করায় ঋণখেলাপিদের সংখ্যা বৃদ্ধি। আবার অনেক উপকারভোগীর অভিযোগ, তারা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণে ঋণ নিয়ে প্রত্যাশানুযায়ী আয়রোজগার করতে পারছেন না।
ব্যয় পর্যালোচনার তথ্যানুযায়ী, সমিতির সভাপতি, ম্যানেজার ও অন্যান্যদের সম্মানী ভাতা বাবদ মোট দুই লাখ ৫০ হাজার জনের খরচ ধরা হয় ২৮৫ কোটি টাকা। যেখানে জনপ্রতি ব্যয় ১১ হাজার ৪০০ টাকা। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ খাতে ১০ লাখ ২৯ হাজার ৭৯৪ জনের জন্য ১৬৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়। কিন্তু এখানে প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা ছিল বলে আইএমইডি বলছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের অর্জনের মধ্যে রয়েছে, গত মে পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয়ের মধ্যে সাত হাজার ২৮৭ কোটি ছয় লাখ ৪৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৯২.৪১ শতাংশ। মূল কায়ক্রম প্রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। উপকারভোগী ৫৪ লাখ ৬০ হাজার জন নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুই লাখ ১৭ হাজার বেশি নির্বাচন করে মোট ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার করা হয়েছে।
আইএমইডিকে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, সমিতির সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শতভাগ নিয়ম মেনে অনেক ক্ষেত্রে সদস্য নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি।
আইএমইডির পর্যবেক্ষক কর্মকর্তা ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা দ্বৈব চয়নের মাধ্যমে ১২ শ’ উপকারভোগীর ওপর এই জরিপ চালান। মাঠপর্যায়ে আলাপকালে দেখা গেছে ঋণের প্রকৃত উদ্দেশ্য আয়বর্ধক খামার স্থাপন করে আয় বাড়ানোর তথ্য দারিদ্র্যবিমোচনে অনেক সদস্যই আগ্রণী নন। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ একটি বড় ঝুঁকি এই প্রকল্পের জন্য। এ ছাড়া সমিতির ম্যানেজার ও এ প্রকল্পের যেসব কর্মচারী সদস্যদের অর্থ আদায় ও জমা করার দায়িত্ব পালন করে তাদের অসততা ও দুর্নীতি অন্যতম ঝুঁকি।
প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আকবর হোসেনের সাথে প্রকল্পে উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ না হওয়ার ব্যাপারে আইএমইডির প্রতিবেদন সম্পর্কে গতকাল ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, পুরো প্রকল্পে উপকারভোগীর সংখ্যা হলো ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার। তার মধ্যে থেকে আইএমইডি কিছু মানুষের ওপর জরিপ করে এই তথ্য দিয়েছে। এখানে সঠিক চিত্র আসেনি। তিনি বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদন শুনেছি। দেখিনি। আমাদের সাথে আলোচনা করে তারা করেননি। নিজেদের মতো করে করেছেন। তিনি বলেন, দু-একটা মিটিংয়ে আমাদের ডেকেছিল, আমরা সেখানে বলেছিলাম, সারা বাংলাদেশের চিত্র এটা হতে পারে না। তবে একবারেই যে এমন ঘটনা হয়নি সেটি নয়। তাদের স্যাম্পলিং কতটা করেছে? ৫৬ লাখের মধ্যে যেটা করেছে সেটা কি গ্রহণযোগ্য হয়। তারপরও আমাদের বলার কিছুই নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে সরকারি অনুদান জড়িত সেখানে, কতটা সুষ্ঠুভাবে শতভাগ করা যায় কি-যায় না, এটা বিবেচনা করেন। তবে যদি কিছু এসে থাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করা যাবে না। তবে এখানে ভালো দিকগুলোই বেশি। সেগুলোকে তুলে ধরা উচিত।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/594378/