১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৮:০৫

নদীর পানি কমা-বাড়ার মধ্যেই বাড়ছে ভাঙন

কয়েক দিন ধরে দেশের কিছু নদীর পানি কমছে আবার কিছু নদীর পানি বাড়ছে। এই কমা-বাড়ার মধ্যেই বেড়েছে নদীভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও তা সেভাবে কাজে আসছে না। অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধে বা রাস্তায়। অনেক সরকারি পাকা স্থাপনাও রয়েছে ভাঙনের হুমকিতে।

গতকাল শনিবার বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমছে।

তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, দু-এক দিনের মধ্যেই বৃষ্টিপাত বাড়বে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা হলে বৃষ্টিপাত বাড়বে। নদ-নদীর পানিও ফের বাড়বে।

গতকাল সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

কুড়িগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি কমলেও এখনো বিপত্সীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানি রয়েছে স্থিতিশীল। এই দুটি নদ-নদীর অববাহিকার অর্ধশত চরের নিচু এলাকা প্লাবিত রয়েছে। ডুবে গেছে পাট, বীজতলা, আমন ও সবজি ক্ষেত। এদিকে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও ধরলার ৪০টি পয়েন্টে ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে এসব এলাকার দেড় হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। বাঁধ, রাস্তা ও ফাঁকা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে এসব পরিবার।

তিস্তার ভাঙনে রাজারহাটের খিতাবখা, গতিয়াশাম, বুড়িরহাট, গাবুরহেলানসহ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক পরিবার গত তিন দিনে ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভাঙনের তাণ্ডবে টিকতে না পেরে আধাপাকা বাড়ি ভেঙে ফেলছে অনেকেই। আশ্রয়ের অভাবে অনেকে ঘরের চাল ছড়িয়ে আছে ফাঁকা জমিতে। কেউ কেউ চলে যাচ্ছে চরে। খিতাবখা ও বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে।

রংপুরের মিঠাপুকুরে তরফসাদী ঢব্বার চরে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমিসহ বসতভিটা। চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে ওই চরের বাসিন্দারা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যমুনেশ্বরী নদীতে খুব বেশি পানি নেই। তার পরও ভেঙে যাচ্ছে জমিজমা ও বসতভিটা। কয়েক দিন আগেও যেখানে ছিল ফসলের ক্ষেত, সেগুলো এখন নদীগর্ভে। ধীরে ধীরে নদী গতিপথ পরিবর্তন করে চরগ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে।

তরফসাদী ঢব্বার চরের বাসিন্দা সামছুল ইসলাম বলেন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পুরো গ্রাম ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘জমিজমা যেভাবে ভেঙে যাচ্ছে, তাতে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। কয়েক দিন পর হয়তো আমাদের বসতভিটাও ভেঙে যাবে নদীতে।’

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুন ভূইয়া বলেন, ‘তরফসাদী ঢব্বার চরে যমুনেশ্বরী নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে শুনেছি।’ ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।

উজান থেকে আসা পানিতে শেরপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধির ফলে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে নদীভাঙনের ফলে সদর উপজেলার চরপক্ষিমারী ইউনিয়নের চুনিয়ার চর, ভাগলগড়, ডাকপাড়া এলাকায় অন্তত এক কিলোমিটার এলাকার ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে ওই এলাকায় কয়েক শ বিঘা আবাদি জমিসহ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং অনেকের বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে।

গতকাল ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন করায় চুনিয়ার চর ও ভাগলগড় এলাকায় ১০০ মিটারের মতো উত্তর তীর ভেঙে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অনেক ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। চুনিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙন থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে রয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ১৫ দিন ধরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের চুনিয়ার চর ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় তিস্তা নদীর বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে ওঠে। এতে ডিমলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ১৫টি চরগ্রামে বন্যা দেখা দেয়। এর পর থেকে পানি কমতে শুরু করলে শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ওই পয়েন্টে নদীর পানি বিপত্সীমার সাত সেন্টিমিটার নিচে নামে। ফলে এসব গ্রাম থেকে পানি নেমে যায়। ওই পয়েন্টে গতকাল পানি আরো কমে বিপত্সীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, তিস্তার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত প্রায় ১৫টি চরগ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। শুক্রবার সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করলে স্বস্তি ফিরে আসে। [প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।]

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/07/11/1052222