১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৮:০৩

জ্বর সর্দিকাশি ঘরে ঘরে

ওষুধসংকটের সুযোগে বাড়তি দামের বোঝা

দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে জ্বর, সর্দিকাশির প্রকোপ। এ অবস্থায় বেড়েছে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের চাহিদা। তবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে না পারায় ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও বেশি দামে বিক্রি করছেন ওষুধ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন কালের কণ্ঠ’র সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা :

রংপুরে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। এরই মধ্যে জ্বর, সর্দিকাশির প্রকোপও দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু করোনাভাইরাস নয়, ঋতু পরিবর্তনেরও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে সবখানেই এখন জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে।

ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দিকাশির প্রভাব পড়েছে ওষুধপাড়ায়। চাহিদার কারণে নাপা, নাপা এক্সট্রা, এইচ প্লাস, নাপা সিরাপসহ প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে, বেড়েছে দামও। রংপুর অঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ওষুধের সংকট তৈরি হয়েছে। কঠোর বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত ওষুধ সরবরাহকারী কম্পানি, প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও ব্যবসায়ীদের দাবি, লকডাউনে ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধিদের দেখা মিলছে না। কম্পানি থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সাময়িক এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

চাহিদার অজুহাতে দামও বাড়িয়েছেন ফার্মেসির মালিকরা। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার ফার্মেসিগুলোতে বেশি দামে প্যারাসিটামল বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ মিলছে ফার্মেসি মালিকদের বিরুদ্ধে। ক্রেতাদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় লাভের আশায় ফার্মেসি মালিকরা এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছেন।

রংপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা জানান, ওষুধসংকট সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গায়ও জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটের সুযোগে কোথাও কোথাও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ওষুধ। ক্রেতারাও বিভিন্ন দোকান ঘুরে না পেয়ে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। চুয়াডাঙ্গা শহরের বেশ কিছু দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ নাপা পাওয়া যাচ্ছে না। শহরের অন্যতম বড় এক দোকানদার বলেন, সরবরাহ কমেছে কিন্তু বিক্রি বেড়েছে, এ কারণেই সংকট দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বোয়ালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, গ্রামে মানুষকে দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে জ্বর, ঠাণ্ডার ওষুধ।

দুই সপ্তাহ ধরে বান্দরবান জেলা সদরে ফার্মেসিগুলোতে প্যারাসিটামল গ্রুপের ট্যাবলেটের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে কোনো দোকানেই এসব ওষুধের জন্য বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বান্দরবান জেলা কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শিমুল দাশ জানান, উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না কম্পানিগুলো।

পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদরসহ গ্রাম-গঞ্জের ফার্মেসিতে মিলছে না প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে ফার্মেসি মালিকদের দাবি। তবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈকত ইসলাম বলেন, ‘নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। আমি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে ওষুধের দোকানগুলোতে গোপনে তদারকি করব। কোনো ফার্মেসিতে এই ওষুধগুলো বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পেলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘরে ঘরে বেড়েছে জ্বর, সর্দি, ঠাণ্ডা, কাশির রোগীর সংখ্যা। ফার্মেসিগুলোতে দেখা দিয়েছে প্যারাসিটামলজাতীয় নাপা ওষুধের সংকট। ১০ টাকার নাপা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। কোথাও কোথাও বেশি টাকা দিয়েও মিলছে না ওষুধ। গতকাল দুপুরে হাসপাতাল গেট, আরামনগর বাজার, সিমলা বাজার, বাউসি বাজার, বয়ড়া বাজার, স্টেশন এলাকা, সিংগুয়া মোড়, চরজামিরা এলাকা, আদ্রা মাদরাসা মোড়, চররৌহা বাজার, তারাকান্দি গেটপাড় এলাকা, একুশের মোড়, আওনা পুরাতন ঘাট, মহাদানের চেরাগালির মোড়, পিংনা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ তথ্য জানা যায়।

আরামনগর বাজারে ওষুধ কিনতে আসা রবিউল ইসলাম, বেলাল মিয়া, রহিমা বেওয়াসহ আরো অনেকেই জানান, বাড়িতে একের পর এক সবাই ঠাণ্ডা-জ্বরে ভুগছে। বাজারে নাপা ওষুধ কিনতে এসেছি। বেশি দাম চায়। কোনো উপায় না পেয়ে ১০ টাকার ওষুধ ২০ টাকা দিয়েই নিতে হলো।

সুনামগঞ্জে এক সপ্তাহ ধরে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। সুনামগঞ্জ শহরের স্বর্ণা ফার্মেসির পরিচালক জুনেদ আহমদ বলেন, বেক্সিমকো কম্পানি সপ্তাহখানেক ধরে নাপা ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। তবে একই গ্রুপের অন্য কম্পানির ওষুধ বাজারে আছে।

সুনামগঞ্জ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সৈকত দাস বলেন, নাপা ওষুধটি জনপ্রিয়। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই সাধারণ মানুষ দোকান থেকে এটি অহরহ কেনে। এখন এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বাজারে টান পড়েছে।

নেত্রকোনায় সর্দি, জ্বর চিকিৎসার ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু দোকানে কাঙ্ক্ষিত ওষুধ মিললেও দাম নিচ্ছে বেশি। পৌর শহরের মাহমুদপুরের বাসিন্দা ওয়াসিম জানান, তিনি শহরের একাধিক ফার্মেসিতে নাপা ওষুধ খুঁজে কোথাও পাননি। তাই রোগী নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নেত্রকোনা জেলা শাখার সদস্য বজলুল করিম বলেন, ‘প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধের সংকট রয়েছে। আমরা কম্পানিতে অর্ডার দিয়েও সরবরাহ পাচ্ছি না।’

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডা. উত্তম রায় বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। তবে শহরের কয়েকটি ওষুধের দোকান পরিদর্শনে গেলে ওষুধ আছে বলে ফার্মেসি মালিকরা জানান। আমাদের হাসপাতালে এজাতীয় ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে। কেউ চাইলে আমরা সেখান থেকে দিতে পরব।’ কোথাও না পেলে হাসপাতাল থেকে ওষুধ সংগ্রহ করার পরামর্শ দেন তিনি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/07/11/1052220