১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৭:৫৯

অগ্নিকাণ্ডের মামলার তদন্ত ও বিচারে ‘কচ্ছপগতি’

ভয়াবহ ১১ অগ্নিকাণ্ডে মামলাই হয়নি

বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের মামলার তদন্ত ও বিচার চলছে কচ্ছপ গতিতে। এ দীর্ঘসূত্রতার কারণেই মূলত দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা ভবনে বৃহস্পতিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর দায়িত্বহীনতায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার পাশাপাশি ছিল বিদ্যমান বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করার প্রমাণ।

ভয়াবহতার দিক থেকে ১১ বছরে পাঁচটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে আগুনে ১২৫ জনের মৃত্যু হলেও ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। দায়ীরা সবাই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চারটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও তিনটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এ ছাড়া একটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে চার্জশিট দেওয়া হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ‘কচ্ছপগতি’তে চলছে সেই মামলাটির বিচার কার্যক্রম। তদন্তাধীন তিনটি মামলায় এজাহারভুক্ত ১২ আসামিই জামিনে আছেন। আর বিচারাধীন মামলাটিতে ১৩ আসামির মধ্যে পাঁচজন পলাতক ও বাকিরা জামিনে আছেন।

অবশ্য বরাবরের মতোই আশার বাণী শুনিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। শিগগিরই তদন্তাধীন মামলাগুলোয় চার্জশিট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা। জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবু বকর ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, আইনের মাধ্যমেই মানুষ যে কোনো কিছুর সঠিক প্রতিকার পেতে পারেন। মামলা করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করবেন। এসব মামলায় অপরাধীদের যথাযথ সাজার নজির সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে অপরাধীরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার শঙ্কাও হ্রাস পাবে। তবে অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা না হওয়া দুঃখজনক। এতে ভিকটিমদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অগ্নিকাণ্ড : চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ভোরে পুরান ঢাকার ৯/১১ আরমানিটোলার মুসা ম্যানশনের (ছয়তলা) নিচতলায় রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বংশাল থানার এসআই মোহাম্মদ আলী শিকদার বাদী হয়ে ভবন মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় আসামিদের মধ্যে ৫ জুন তিন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী এবং ৬ জুন মুসা ম্যানশনের মালিক মোশতাক আহমেদসহ দুজন ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান। এর আগে ১২ মে আরও দুজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মোস্তফা ও মোস্তাফিজুর রহমান জামিন পান। এ মামলায় কোনো আসামিই কারাগারে নেই। গ্রেফতার হওয়া সাত আসামিই জামিনে আছেন। মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বেশ কয়েকটি ধার্য তারিখ পার হলেও পুলিশ তা দাখিল করতে পারেনি।

বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড : ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ২৫ জন ও হাসপাতালে একজন মারা যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উদ্ধারকর্মী ফায়ারম্যান সোহেলও মৃত্যুবরণ করেন। আর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৭৩ জন চিকিৎসা নেন। এ ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত ঘটনার দুদিন পর মামলাটি করেন। মামলায় রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুলসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। মামলার পরপরই ৮ এপ্রিল আসামি বিএনপি নেতা তাজভিরুল ইসলাম ও ভবনের জমির মালিক আসামি প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুককে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ১১ এপ্রিল বিএনপি নেতা তাজভিরুল ইসলাম ও ৬ মে ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুকের জামিনও মঞ্জুর করেন আদালত। একই বছরের ২৩ জুন লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুলের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। মামলার পর থেকে অদ্যাবধি অন্তত ৩৫ বার আদালতের কাছ থেকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। তবুও প্রতিবেদন দিতে পারেনি ডিবি পুলিশ।

জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান যুগান্তরকে জানান, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার পদোন্নতি হওয়ায় নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আদালতে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড : ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। এ ঘটনায় স্থানীয় এক ব্যক্তি বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, আসামিদের (ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ) বাড়ির ২য় তলা থেকে ৪র্থ তলা পর্যন্ত বডিস্প্রে, পলিথিনের দানা, কেমিক্যাল মজুত থাকায় আগুন বেড়ে গিয়ে ৬৭ জন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।

মামলার এজাহারে শুধু ওই দুই আসামির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে আদালতের অন্তত ৩৯টি ধার্য তারিখ পার হয়েছে। তবুও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পুলিশ।

জানতে চাইলে চকবাজারের ওসি কাইয়ুম ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে। এ বিষয়ে সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড : ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশন কারখানায় ভয়াবহ আগুনে অন্তত ১১২ জন নিহত ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এতে তাজরিন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪(ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’র অভিযোগ আনা হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। আর মামলার ১৩ আসামি মধ্যে পাঁচ আসামি পলাতক ও বাকিরা জামিনে আছেন।

যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মামলা হয়নি : ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে অগ্নিকাণ্ডে ১০ কর্মী প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টে ২৭ জন এবং মিরপুর-১ নম্বরের মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে আগুনে ২২ শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে ৫৩ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে ১২ শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০১ সালে মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন গুজবে পদদলিত হয়ে ২৪ শ্রমিক মারা যান। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে সান নিটিং গার্মেন্টে আগুনে ২০ শ্রমিক মারা যান। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ আগুনে শিশুসহ ১২৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার কোনোটিতে মামলা হয়নি। দায়ীরা সবাই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/441541/