শেখ কামাল-শেখ জামাল-শেখ রাসেল সেতু। ছবি: সংগৃহীত
১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৭:৫৮

শেখ কামাল-শেখ জামাল-শেখ রাসেল সেতু প্রকল্প

কাজ শুরুর আগে ৮ পিডি পরে আরও ৫

সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ

সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই হাতে নেওয়া হয়েছিল ‘পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে শেখ কামাল সেতু, শেখ জামাল সেতু এবং শেখ রাসেল সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়নে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ১৩ জন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। এরমধ্যে কাজ শুরু আগে ছিলেন আটজন এবং শুরুর পর বাকি পাঁচজন দায়িত্ব পালন করেন। তার সবাই ছিলেন অস্থায়ী ভিত্তিতে এবং ওই এই প্রকল্প ছাড়াও একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করতেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরুতে অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে বাড়তি খরচ গেছে ৪৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে বাড়তি সময় লেগেছে ৬৬ মাস বা ১৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। সমাপ্ত এ প্রকল্পে প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তবে ঘন ঘন পিডি বদল এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্প নেওয়ায় প্রকল্পটিতে বাড়তি সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হলেও এখনো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়নি। চলমান লকডাউনের কারণে প্রক্রিয়াটি আটকে আছে। অফিস খুললেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যাতে করে প্রকল্পটিতে যেসব সমস্যা ছিল সেসব আগামীতে অন্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে না হয়।

এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পিডি নিয়োগে দুই ধরনের সিস্টেম আছে। একটি হলো বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট কিংবা সরকারি অর্থের বড় প্রকল্পে আলাদা পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যটি হলো, ছোট প্রকল্পে সাধারণত জোনভিত্তিক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীরা দায়িত্ব পালন করেন। তারা যখন বদলি হয়ে যান, তখন পিডিও বদল হয়। এ কারণে প্রকল্পের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তবে এখন আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই করেই প্রকল্প নিচ্ছি। ফলে এ প্রকল্পে যেসব সমস্যা ছিল সেগুলো আর থাকবে না।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮ বছর নির্মাণকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করা ১৩ জন প্রকল্প পরিচালক হলেন- সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মমিনুল হক, আমিনুর রহমান দুবার ছিলেন, আব্দুল কুদ্দুস-১, আশরাফুল ইসলাম খান, সৈয়দ মোশাহেদ আলী, আবদুস সবুর এবং সোহরাব উদ্দিন মিয়া দুবার ছিলেন। এছাড়া প্রকৌশলী দিলীপ কুমার গুহ, গুলজার হোসেন, তাপস কুমার পাল, ইমদাদ হোসেন এবং প্রকৌশলী আশরাফুল আলম। সবাই খণ্ডকালীন হিসাবে এ প্রকল্পে পিডির দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি সবাই ছিলেন একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বেও।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে তিনটি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৩০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। পরে প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। শুরু থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ১৭৫ কোটি ৭৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। যেটি মূল অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৪৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ অর্থ।

এছাড়া ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। পরে দফায় দফায় মেয়দ বাড়িয়ে বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের জুনে। তবে প্রকল্পটি ২০০৯ সালে শুরুর কথা থাকলেও নানা কারণে সেটি হয়নি। প্রায় আড়াই বছর পর প্রকৃত বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১১ সালের জুনে। সময়মতো ২০১১ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হলে এলাকার জনগণ ও দেশবাসী ৬ বছর আগেই প্রকল্পের সুফল ভোগ করতে পারতেন। প্রকল্পটি গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। সম্ভব্যতা যাচাই করা হলে এতে প্রকল্পভুক্ত এলাকার আর্থ-সামাজিক তথ্য থাকলে প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন সহজতর হতো এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেত।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সেতু নির্মাণের পর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের আওতায় ১ বছর সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে। পরে পটুয়াখালী সড়ক বিভাগকে রাজস্ব খাতে পরিচালনার জন্য হস্তান্তর করেছে। ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কোনো এক্সিট প্ল্যান নেই। তবে প্রকল্পটি যে উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল সেটি অর্জিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শেখ কামাল সেতুতে আন্ডারপাস আছে, যেটি এখনও ভালো আছে। কিন্তু আন্ডারপাসের পাশের ড্রেনের ব্যবস্থাপনা দুর্বল। সম্পূর্ণ ড্রেন ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে আছে। সেতুর উপরিভাগ যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত, আরামদায়ক ও নিরাপদ। সিসি ব্লক দিয়ে সেতুর প্রটেকশন বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। এক্সপানশন জয়েন্টগুলো অপরিষ্কার এবং পানি চুইয়ে পড়ে শ্যাওলা জমে আছে। সেতুতে মাত্র চারটি সোলার লাইট জ্বলতে দেখা গেছে। সেতুর নামফলক অত্যন্ত ছোট। অন্যান্য সড়ক যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা চিহ্ন অপ্রতুল। সেতুর মধ্যবর্তী স্প্যানের উভয় পার্শ্বে হঠাৎ লেভেল ডাউন হয়ে আছে, যাতে দ্রুত চলমান যানবাহনের ঝাঁকুনি হয়, দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। এক্সপানশন জয়েন্টগুলো অপরিষ্কার ও পানি চুইয়ে পড়ে শ্যাওলা জমে আছে। একটি পিয়ারের ফেল্ডার পিলার নৌযানের আঘাতে বাঁকা হয়ে গেছে। শেখ রাসেল সেতুর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আন্ডারপাস খুব ভালো আছে। তবে এর পাশের ড্রেনের ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। সম্পূর্ণ ড্রেন ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। এক্সপানশন জয়েন্টগুলো অপরিষ্কার ও পানি চুইয়ে পড়ে শ্যাওলা জমে আছে। সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডে পেভমেন্ট থেকে শোল্ডার বেশ কিছুটা নিচে দেখা গেছে, যা যানবাহনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/441539/