নারাণয়গঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে ভস্মীভূত হাসেম ফুডসের কারখানা। শনিবারের ছবি -যুগান্তর
১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৭:৫৫

রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড : লাশ পেতে ৩ সপ্তাহের অপেক্ষা

থামছে না কান্নার আওয়াজ

সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৮ জন রিমান্ডে

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এখনো থামছে না অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের স্বজনের কান্নার আওয়াজ। বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা ভবনের আগুনে প্রাণ গেছে ৫২ জনের। এরমধ্যে চারজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

কিন্তু বাকি ৪৮ জনের লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। কারণ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া এসব লাশ চেনার উপায় নেই। ডিএনএ টেস্টের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে অন্তত ৩ সপ্তাহ লাগবে। এরপরও প্রিয়জনের লাশের সন্ধানে স্বজনরা ছুটছেন কারখানা থেকে হাসপাতাল, হাসপাতাল থেকে মর্গে, মর্গ থেকে ডিএনএ বিশেষজ্ঞদের কাছে। শনিবারও ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল মর্গের সামনে এবং নিহতদের গ্রামের বাড়িতে ছিল শোকের মাতম।

এদিকে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হাসেমসহ আটজনকে ৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শনিবার বিকালে তাদের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন আদালত। এর আগে দুপুরে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর সবাইকে আদালতে হাজির করা হয়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ঘটনার সঙ্গে দায়ী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকেই উপযুক্ত বিচারের মুখোমুখি করা হবে। অন্যদিকে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস।

হাসেম ছাড়াও অন্য যাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন হাসেমের চার ছেলে-হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম। অন্য তিনজন হলেন-হাসেম ফুড লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও অ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিন।

তাদের সবাইকে শনিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খানমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবর রহমান জানিয়েছেন, এটা হত্যা নয়; গণহত্যা। গণহত্যার প্রকৃত রহস্য বের করতে হলে আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, এটা কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। এটা একটি নিছক দুর্ঘটনা। এ মামলায় আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আসামিদের জামিন দেওয়া হোক। রিমান্ড এবং জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত তাদের প্রত্যেকের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হত্যা মামলার পর আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন রূপগঞ্জ থানাধীন ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক নাজির উদ্দিন মজুমদার। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জন আসামি আছেন। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওই কারখানায় বিদ্যুতের কাজের দায়িত্বে ছিলেন সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সজীব হোমস লিমিটেডের ডিজিএম ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম। অগ্নিদুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

শনিবার ভবনের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, মেশিনারিজসহ প্রত্যেক ফ্লোরের সব মালামাল পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের নানা নজিরও চোখে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছে, ভবনটি তৈরিতে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। প্রতি তলাতেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি মালামাল রাখা হতো।

এতে শ্রমিকদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত ছিল সব সময়। জরুরি নির্গমনের পথও ছিল মালামালে ঠাসা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভবনের চতুর্থ তলার একটি এসি রুমে তালাবদ্ধ অবস্থায় আটকে পড়ে মারা যান ৪৯ জন শ্রমিক। বাঁচার জন্য শ্রমিকরা সেখান থেকে টেলিফোনে আর্তি জানিয়েছেন স্বজন ও কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে।

কিন্তু এতে কোনো কর্ণপাত করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। দায়িত্বশীলরা তখন বলেছিলেন, এটা ছোট আগুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে যাবে। কারও নিচে নামার দরকার নেই। পরে ওই রুমটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এ কারণে প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারেননি কেউ। যে সুপারভাইজার শ্রমিকদের সেখানে আটকে রেখেছিলেন তিনিও মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অগ্নিকাণ্ডকে ‘মানুষ হত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মর্মান্তিক এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত ৩টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও মামলার তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারও ন্যূনতম দোষ বা গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠিন বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একসঙ্গে এতজন লোকের প্রাণহানিতে সারা দেশে শোক বিরাজ করছে। হাসেম ফুড ফ্যাক্টরির কতজন লোক এখানে কাজ করছিলেন সেটা তদন্তে বের হয়ে আসবে। তদন্তের পরই আমরা বলতে পারব, এখানে কেন এ ঘটনা ঘটেছে। যা হয়েছে তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক। যারা ইন্তেকাল করেছে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। যে কজন হাসপাতালে জীবিত আছেন, আমরা মনে করি তারা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। আত্মীয়-স্বজনকে যেন আল্লাহ শোক সহ্য করার সামর্থ্য দেন এ কামনা করি। সরকারিভাবে ডিসি তাৎক্ষণিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাদের দুঃখ লাঘবের জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে।

কারখানায় অনেক শিশু শ্রমিক কাজ করত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এখানে শিশু শ্রমিকও থাকতে পারে, বিল্ডিং তৈরির ত্রুটি থাকতে পারে। আমরা তদন্তের আগে কিছু বলতে পারব না। তদন্তে সব বের হবে এবং কেউ ছাড় পাবে না। তদন্তে যে কোনো ত্রুটি বেরিয়ে এলে অবশ্যই বিচার হবে। ছাদে ওঠার সিঁড়িতে তালা লাগানোর প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্তের সামান্যতম ত্রুটি বা গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রী আরও বলেন, প্রথমত ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ইউএনও, ডিসি তাৎক্ষণিকভাবে এখানে এসেছেন। ১৭ জনকে জীবিত উদ্ধারও করেছেন। তাদের বেগ পেতে হয়েছে আগুন নেভাতে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান শনিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভবনটিতে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল না। পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট ছিল না। ছিল না কোনো অগ্নিনির্বাপণের সুব্যবস্থা। আমরা আগুন নেভানো শেষে কয়েকটি ফ্লোর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। এছাড়া ভবনটিতে প্রাথমিকভাবে আরও অনেক ত্রুটি পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। তিনি বলেন, আগুন নেভানো শেষে ভবনটির অনেকাংশে ফাটল ধরেছে। কোনো কোনো অংশ ধসে পড়েছে। ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে অপর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন জেলার এসপি জায়েদুল আলম।

শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রত্যেকের পরিবারকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। এছাড়া চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকদের রোববার ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে।

মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, নিহত ৪৮ জনের লাশ সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ২৫ জন ও জরুরি মর্গে ৮ জন এবং সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জনের লাশ সংরক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। লাশগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে তাদের আত্মীয়স্বজনের ডিএনএর সঙ্গে মেলাতে অন্তত ৩ সপ্তাহ সময় লাগবে বলে ডিএনএ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএর নমুনা দিতে নিহতদের স্বজনরা জানিয়েছেন, কারখানায় কাজ করত কয়েকশ শিশু। মেডিকেলে আসা নিহতদের আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের বুকফাটা কান্না আর আহাজারিতে ক্ষণে ক্ষণে ভারি হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ।

সিআইডির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন যুগান্তরকে বলেন, গতকাল (শুক্রবার) ও আজকে (শনিবার) মিলিয়ে ৪০টি মরদেহের বিপরীতে শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৫৬ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামীকালও (আজ রোববার) আমাদের নমুনা সংগ্রহের কাজ চলতে পারে। এর পরেও যদি কেউ নমুনা দিতে চান তাহলে সিআইডি হেডকোয়ার্টারে এসে নমুনা দিতে পারবেন। আমরা ইতোমধ্যে লাশের স্যাম্পল কালেকশন শুরু করেছি। সেগুলো ইতোমধ্যেই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষাটি বেশ লম্বা সময়ের। এ ধরনের নমুনা থেকে ৩-৪ সপ্তাহের আগে কিছু বলা সম্ভব নয়। যে স্যাম্পলগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ সেগুলোর ক্ষেত্রে আরও বেশি সময়ও লাগতে পারে। ডিএনএ নমুনা হিসাবে নিহতদের বাবা, মা, ছেলেমেয়ের রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিহতদের ভাইবোনদের।

ডিএনএ বিশেষজ্ঞ সাব-ইন্সপেক্টর বিশ্বজিৎ চন্দ্র দে যুগান্তরকে বলেন, লাশগুলো ভীষণভাবে পুড়ে গেছে। পোড়া মৃতদেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হলো হৃদযন্ত্রের রক্ত। এই রক্ত অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে। এই রক্ত যদি আমরা সংগ্রহ করতে পারি বা ফরেনসিক থেকে সঠিকভাবে কন্টামিনেশন (দূষণ) ছাড়া নিতে পারি তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিহতদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। মাংসের অংশ ভালো থাকলে সেখান থেকে টিস্যু নিয়েও তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এর কোনোটাই যদি সম্ভব না হয় তাহলে সর্বশেষ ভরসা হচ্ছে হাড়। এই হাড় প্রসেসিং হতে ২০-২৫ দিন সময় নেয়।

এদিকে নিহত ১৬ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- রিমা আক্তার, মিতু আক্তার, মো. নাঈম ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, মো. রাকিব দেওয়ান, মো. সাজ্জাদ হোসেন সজীব, রাবেয়া খাতুন, জিহাদ রানা, নাজমুল হোসেন, সেলিনা আক্তার, তাসলিমা আক্তার, ফাতিমা আক্তার, নুসরাত জাহান টুকটুকি, অমৃতা বেগম, স্বপন মিয়া, নাজমা খাতুন। উল্লিখিতদের পরিবার থেকেও ইতোমধ্যেই ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হয়েছে।

শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, নিহতদের খোঁজে আসা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের বিলাপে কিছুক্ষণ পরপরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছিল। ১৩ বছর বয়সি নাজমুল হোসেন চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, আমি আর মা দুজনই সেজানের কারখানায় কাজ করতাম। আমি ২য় তলায় আর মা ৩য় তলায়। বৃহস্পতিবার আমার ডিউটি ছিল বিকাল ৪টা পর্যন্ত। আমি এরপর বাসায় চলে যাই। কিন্তু আমার মা সালমা বেগম কারখানাতেই কাজ করতে থাকেন। আগুন লাগার কথা শুনে আমি কারখানায় ছুটে আসি। নাজমুল আরও জানায়, সেজানের এ কারখানায় কয়েকশ শিশু শ্রমিক হিসাবে কাজ করত। সে বেতন পেত ৬ হাজার টাকা আর তার মা বেতন পেত সাড়ে ৫ হাজার টাকা।

মোহাম্মদ আলীর মরদেহের খোঁজে মর্গের সামনে এসেছিলেন তার ভাই মিজানুর রহমান। তিনি বললেন আরেক করুণ কাহিনি। বলেন, আগুন লাগার পর ৬টা ৩ মিনিটে ভাই আমারে ফোন দিছিল। দিয়ে বলল, তোরা আমারে মাফ করে দিস। আমার জন্য দোয়া করিস। আর আমার ছেলেরে দেখিস। আমি জিজ্ঞাস করলাম, তোর কি হয়েছে ভাই? ও বলল, আমার চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া। আমি চোখে কিছু দেখছি না। নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। আমি উপরে উঠে যেতে বললে সে বলল, তাদের ফ্লোরের গেটে আর সিঁড়ি তালা মারা। তার সঙ্গে আরও ৫০-৬০ জন ছিল বলেও জানায়।

প্রতিটি ফ্লোর ছিল কেমিক্যালে ঠাসা : ভবনের প্রতিটি ফ্লোর ছিল কেমিক্যালে ঠাসা। ছয় তলায় ছিল কার্টনের গুদাম। কিছু কার্টনে ছিল জুস তৈরির রাসায়নিক কাঁচামাল। আর পঞ্চম তলায় রাখা হতো বিভিন্ন রাসায়নিক ও প্লাস্টিক মোড়ক। চতুর্থ ও তৃতীয় তলায় উৎপাদিত হতো সেজান জুসের বিভিন্ন পণ্য। সেখানে ছিল সারি সারি পণ্য ভর্তি কার্টন। তৃতীয় তলায় ক্যান্ডি লাইন নসিলা উৎপাদনের প্ল্যান্ট। এ ফ্লোরে ছিল বিভিন্ন ফ্লেভারযুক্ত কেমিক্যাল, সুগার ও গ্লুকোজ কার্টন এবং মোড়ক উৎপাদনের পলিথিন। চতুর্থ তলায় স্টোরসহ লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, আচার, ঝালমুড়ি তৈরি হতো। তবে এ ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেলের ড্রাম ছিল। ইলেকট্রিক চুলায় বড় সাইজের ৪-৫টি কড়াই ছিল। ঘটনার সময় কড়াইয়ে আচার তৈরির কাজ চলছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর ড্রামভর্তি তেল জ্বলে গিয়ে ভয়ংকর আকার ধারণ করে।

নিচ তলায় ছিল কার্টন এলডিপি বা প্লাস্টিকের পলি উৎপাদন প্ল্যান্ট। এখানে আরেকটি স্থানে প্রসেস করা হতো ময়দা। ছিল কম্প্রেসার মেশিন। রাখা ছিল ফয়েল পেপারের বড় বড় রোল। পাশেই ছিল আঠা জাতীয় রাসায়নিক উপাদানের প্লাস্টিকের কয়েকটি ড্রাম। দ্বিতীয় তলায় লিচু ড্রিংকস ও লাচ্ছি তৈরি হতো। তৈরি হতো এসব পণ্যের প্লাস্টিক বোতলও। ছিল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল রেজিনের মতো দাহ্য পদার্থ। এসব কেমিক্যাল ভর্তি অর্ধশত প্লাস্টিকের ড্রাম দেওয়াল দিয়ে সাজানো ছিল। নিচতলা ছিল সব ড্রিংকস ও বিস্কুট উৎপাদন প্ল্যান্ট। এখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল। মূলত পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার দুটি ফ্লোরে গুদাম হিসাবে রাখা হলেও সবকটি ফ্লোরেই ছিল রাসায়নিক উপাদান ভর্তি কার্টন, প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে ঠাসা।

নিন্দা, ক্ষোভ, বিচার দাবি : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের এক বিজ্ঞপ্তিতে শনিবার বলা হয়, শুধু কারখানা মালিককে গ্রেফতার করলেই চলবে না। কারখানা পরিদর্শককেও গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, একের পর এক অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসের ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিকের তাজা প্রাণ ঝরে গেলেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ জানায়, উদ্ধার কাজে দীর্ঘসূত্রতায় অনেকের লাশ গুম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রায় ২০০ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। এখনো অনেকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার কথায় কথায় উন্নয়নের সাফাই গাইলেও অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি, পর্যাপ্ত লোকবল ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করেনি। সজীব গ্রুপ ওয়ার্কার্স জাস্টিস কমিটি জানিয়েছে, সজীব গ্রুপের কারখানায় বিপজ্জনক এবং অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/441533/