১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৭:৫৩

ভারতে ৪ টন আম প্রেরণ : আর ওরা টিকা সাপ্লাই বন্ধ করেছে : তিস্তার পানিও দিচ্ছে না

গত ৫ জুলাই সোমবার ইংরেজী ডেইলি স্টারের শেষ পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম বক্স করে একটি বড় খবর ছাপা হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, Bangladesh sends mangoes to ASEAN friends. অর্থাৎ আসিয়ানভুক্ত বন্ধু দেশসমূহে বাংলাদেশ আম পাঠাচ্ছে। খবরে বলা হয়েছে, “সারাবিশ্ব যখন করোনা ভাইরাস মহামারিতে জর্জরিত ও ক্ষতবিক্ষত তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বন্ধু বলে বিবেচিত ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধু বলে বিবেচিত অনেক দেশে সুমিষ্ট আম পাঠাচ্ছেন। যেসব আম পাঠানো হচ্ছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাঁড়িভাঙ্গা। হাঁড়িভাঙ্গা আম রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁওয়ে প্রধানত উৎপন্ন হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোভিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়ের জন্য ২৬০০ কেজি (দুই হাজার ছয় শত কেজি) আম পাঠানো হয়েছে। রোববার বেনাপোল বন্দর দিয়ে এই ২৬০০ কেজি আম পাঠানো হয়। কলকাতায় কিছু আম মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জন্য রেখে দিয়ে অবশিষ্ট আম ট্রেনযোগে (রাজধানী এক্সপ্রেস) দিল্লী পাঠানো হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, তারা রংপুর সফর করেছেন। উদ্দেশ্য, সবচেয়ে ভাল আম যেন সংগ্রহ করা হয় এবং এই সংগ্রহে স্বাস্থ্যবিধি যাতে পালন করা হয়।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে শুভেচ্ছার নিদর্শন। মন্ত্রিসভার বিগত বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতে ইলিশ মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়। অতীতে ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসাররা বলেন, এবারই প্রথম ভারতে আম পাঠানো হচ্ছে। এই রিপোর্টে ডেইলি স্টার যে মন্তব্য করেছে সেটির হুবহু বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ, “এই আম পাঠানোর ঘটনা এমন এক সময় ঘটছে যখন বাংলাদেশের জনগণ ভারতের ওপর খুশী নয়। কারণ বাংলাদেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধী টিকা পাঠানো বন্ধ করে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৩ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি ছিল। কিন্তু জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৭০ লক্ষ ডোজ টিকা পাঠিয়ে ভারত অকস্মাৎ বাংলাদেশে টিকা সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। সেরাম ভারতে প্রস্তুত অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার উৎপাদক। বাংলাদেশের ১৫ লক্ষ মানুষ এই টিকার এক ডোজ নিয়েছেন। এই ১৫ লক্ষ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার আগেই ভারত টিকার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।”
ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘকাল ঝুলে আছে। এমন অবস্থার মধ্যে বন্ধুত্বের শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে ভারতে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাঠানো হলো। সোমবার ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের কাছে ৩০০ কেজি (তিনশত) আম পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন যে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বাস শর্মা, মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরার্ড থাংমার কাছেও আম পাঠানো হবে। (এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন, অর্থাৎ রোববারের মধ্যে হয়তো আসাম, মিজোরাম এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে বাংলাদেশের আম পৌঁছে গেছে)।
পহেলা জুলাই বাংলাদেশ ভুটানের রাজা জিগমে কেশর নামজেল ওয়াংচুক এবং প্রধানমন্ত্রী লোটে জেরিং-এর কাছে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাঠিয়েছে। উল্লেখ্য, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী একজন চিকিৎসক। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপাল, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কাতেও আম পাঠাবেন। এসব দেশ ছাড়াও ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতভার, বাহ্রাইন এবং কুয়েতের রাজপরিবারেও আম পাঠানো হবে।

॥ দুই ॥
কিছুক্ষণ আগে আমি বলেছি যে, যেদিন এই লেখাটি ছাপা হবে, সেদিন, অর্থাৎ রোববারের মধ্যেই ভারতের আরও তিনটি প্রদেশে বাংলাদেশের আম পৌঁছবে। রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতেই একাধিক দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে দেখলাম যে আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আরো ১২০০ কেজি আম পাঠানো হয়েছে। এই নিয়ে ভারতে ৪১০০ (চার হাজার একশত) কেজি আম পাঠানো হলো। ৪ হাজার ১০০ কেজি সমান ৪ টন একশত কেজি। সোজা কথা নয়। এবার আম গত বছরের তুলনায় কিছুটা সস্তা ছিল। ৬০ টাকা কেজি আম্রপালি এবং হাঁড়িভাঙ্গা আম। গত বৃহস্পতিবার সেই আম হয়েছে ৮০ টাকা কেজি। অর্থাৎ কেজি প্রতি ২০ টাকা বৃদ্ধি। জিজ্ঞেস করলাম, “বেশি দাম নিচ্ছ কেন? বিক্রেতা বলল, “স্যার, এই দামে নিয়ে যান। পরে দাম আরো বাড়বে।” প্রশ্ন করলাম, “কেন বাড়বে?” সোজা সাপ্টা উত্তর, “উত্তরবঙ্গ থেকে সব আম ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে।”
শুভেচ্ছার ব্যাপারে নাকি কোনো কথা বলা উচিত নয়। সেটা নাকি ভদ্রতার বাইরে। তো শুভেচ্ছা কি কোনোদিন একতরফা হয়? বাংলাদেশ তো অতীতে কতবার শুভেচ্ছা দেখালো। এদেশ থেকে জামদানি শাড়ি পাঠানো হলো। অথচ শাড়ি কাপড়ে ভারত সমৃদ্ধ। কই, তারা তো কোনোদিন শুভেচ্ছা হিসাবে শাড়ি পাঠায়নি। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে টনে টনে ইলিশ পাঠানো হলো। কই, তারা তো বিনিময়ে অন্য কিছু পাঠায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “ভারতকে আমরা যা দিয়েছি সেটা তারা চিরকাল মনে রাখবে।” প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেননি যে বিনিময়ে বা প্রতিদানে আমরা কি পেয়েছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫০ বছর পার হয়ে গেল। কোনোদিন কোনো সরকার তো এই ৫০ বছরে আম পাঠায়নি। এবার কোনো পাঠানো হলো? তাও এমন এক সময় পাঠানো হলো যখন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং শত শত লোক মারা যাচ্ছে। আর এমন ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশে সেরামের টিকা পাঠানো বন্ধ করেছে। ১৫ লাখ মানুষ ভারতীয় টিকার এক ডোজ নিয়ে বসে আছেন। দ্বিতীয় ডোজ নাই। শূন্যে ঝুলে আছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত উপহার হিসাবে হলেও আমাদেরকে ১৫ লাখ টিকা দাও। কারণ আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। এই ১৫ লাখ লোক শূন্যে ঝুলে আছে। অন্তত এই ১৫ লাখ লোককে বাঁচান। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সকাতর অনুরোধেও ভারত কর্ণপাত পরেনি।

॥ তিন ॥
অথচ তাদেরকে ৪ টনেরও বেশি আম পাঠানো হলো। যেদিন ২ হাজার ৬০০ কেজি আম ভারতে পৌঁছলো সেদিন, অর্থাৎ সোমবার ভারতের ঢলের পানিতে তিস্তা টইটুম্বুর। ভারতের ঢলের পানিতে মরা তিস্তায় যৌবন এসেছে এবং রংপুরের তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এটাই তো তারা করে। বর্ষাকলে পানিতে ডুবিয়ে মারে, আর শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে মারে। এব্যাপারে ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত বাংলাদেশের একটি বাংলা দৈনিকে গত বুধবার ৭ জুলাই লিখেছেন, “২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের বছর নরেন্দ্র মোদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে মমতাকে পাশে বসিয়ে রেখে শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘আমার এই প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদের মধ্যে আমি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা জল বণ্টন চুক্তি করবো।’ তার সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিনি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেছেন। শেখ হাসিনাও পরের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মোদির সেই প্রতিশ্রুতি ২০২১ এ এসেও বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি এবছরের ২৬ মার্চ মোদি যখন বাংলাদেশে যান তখন সে দেশের মানুষ ভেবেছিনে, হয়তো তিস্তা চুক্তি নিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু তাদের সে আশায় জল ঢেলে মোদি বাংলার নির্বাচনের স্বার্থে মতুয়াদের ভোট পাওয়ার আশায় তাদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কথা শুনিয়ে এসেছেন।”

॥ চার ॥
শুধুমাত্র তিস্তার পানি নয়, গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়েও শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে পানি চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তিতেও বাংলাদেশের যতটুকু পানি পাওয়ার কথা ছিল, প্রতিবছরই বাংলাদেশ তার চেয়ে অনেক কম পানি পেয়েছে। এ সম্পর্কে গত ৩ জুলাই ‘দৈনিক সংগ্রামে’ একটি তথ্যবহুল সংবাদ ছাপা হয়েছে। ঐ খবরে বলা হয়েছে যে ৩০ সালের পানি চুক্তির ২৪ বছরেও চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। বরং এই চুক্তির ফলে পানি না পাওয়ায় ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মা গড়াই নদীসহ ১৮ টি নদী পানিশূন্য হয়েছে। আলোচ্য খবরের সাথে একটি ছবি ছাপা হয়েছে। এই ছবিতে দেখা যায় যে পদ্মায় পানি না থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে জেগেছে বিশাল চর। সেই চরে দেখা যাচ্ছে, পর্যটকদের ভিড়। খবরে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীতে পানি শূন্যতার কারণে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১১টি স্প্যান চরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও যশোর জেলার ১৩ টি উপজেলার ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
খবরটি অনেক বড়। তাই আর বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। শুরু করেছিলাম ভারতে আম পাঠানো নিয়ে। ভারত আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ২৬ গুন বড়। জনসংখ্যা ৮ গুন বেশি। ২৯ টি রাজ্য। এই বিশাল দেশটিতে বিপুল পরিমাণ হরেক কিসিমের আম উৎপাদিত হয়। কই, তারা তো পাল্ট শুভেচ্ছা স্বরূপ বাংলাদেশে কোনো আম পাাঠায় নাই। শুভেচ্ছা কি ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক? বাংলাদেশ তাদের ট্র্যানজিট দিয়েছে, বন্দর দিয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। আর কি করবে? তবুও কি তিস্তার পানি পাবো না?
Email : asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/458254