৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৬

পিস্তল উঁচিয়ে শিক্ষক পেটাল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা

রাজশাহীর দুর্গাপুরে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে না জানিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির তালিকা করায় প্রধান শিক্ষকসহ তিনজনকে পিটিয়ে আহত করেছে দলটির স্থানীয় একদল নেতাকর্মী। গতকাল বুধবার সকালে উপজেলার কালীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মজিদ সরদারের নেতৃত্বে তাঁর লোকজন এ হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় বিদ্যালয়ের কার্যালয় কক্ষ।

পিস্তল উঁচিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এ হামলার দৃশ্য দেখে আতঙ্কে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়ে।
হামলায় আহত তিনজন হলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন (৫৫), সহকারী শিক্ষক (শরীরচর্চা) সাইফুল ইসলাম (৪০) ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির ছেলে রবিউল ইসলাম (৪২)। তাঁদের মধ্যে প্রধান শিক্ষককে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং অন্য দুজনকে দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলে, সকাল ১০টার দিকে পাঠদান শুরু হওয়ার পরপরই কার্যালয় কক্ষের দিক থেকে চিৎকার শুনতে পায় তারা। তারা সবাই শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে কার্যালয় কক্ষের দিকে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে, কয়েকজন মিলে প্রধান শিক্ষককে পেটাচ্ছে। ওই দৃশ্য দেখে কয়েকজন শিক্ষার্থী আতঙ্কে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে আশপাশের লোকজন এসে তাদের সরিয়ে নিয়ে শুশ্রূষা করে।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, কয়েক দিন আগে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে একটি তালিকা পাঠানো হয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মজিদ কয়েক দিন ধরেই প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেনকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। গতকাল আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী হঠাৎ বিদ্যালয়ে এসে হাজির হয়। এ সময় পাঠদান চলছিল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে তাঁকে হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা হৈচৈ শুনে ছুটে আসে। কিন্তু মজিদ ও তাঁর লোকেরা পিস্তল উঁচিয়ে প্রধান শিক্ষককে মারধর করতে থাকে।
ওই শিক্ষকরা আরো জানান, প্রধান শিক্ষককে রক্ষা করতে গেলে হামলাকারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির ছেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগকর্মী রবিউল ইসলামকেও মারধর করে। এ সময় তারা কার্যালয় কক্ষও ভাঙচুর করে। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আব্দুল ওয়াদুদ দারার লোকজন এসে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়। তখন মজিদ ও তাঁর লোকজন বিদ্যালয় ছেড়ে পালিয়ে যায়।
আহতদের মধ্যে রবিউল ইসলামকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তাঁর বাম হাতের আঙুল কেটে গেছে। সহকারী শিক্ষক সাইফুলকেও মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। পরে তাঁদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দেওয়ান নাজমুল আলম জানান, আহতদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেনকে লাঠি ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করা হয়েছে। তাঁর ডান চোখের নিচে হাতুড় দিয়ে আঘাত করার কারণে ফুলে রক্ত জমাট বেঁধেছে। এ ছাড়া ডান কানের পর্দা ফেটে রক্ত বের হয়। তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
দুর্গাপুর থানার ওসি রুহুল আলম জানান, খবর পেয়ে কালীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পুলিশ পাঠানো হয়। তবে তার আগেই হামলাকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। বিদ্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মামলা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মজিদ সরদার কালের কণ্ঠ’র কাছে দাবি করেন, অভিভাবক সদস্যদের না জানিয়ে সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারার কথামতো প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যদের একটি তালিকা শিক্ষা বোর্ডে পাঠিয়েছেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু অভিভাবক শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ করে নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনের দাবি করেন। গতকাল বোর্ড প্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মানিকের সরেজমিন তদন্ত করার কথা ছিল। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের আপত্তির কারণে তিনি সেখানে যাননি। এ নিয়ে অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে ধাক্কাধাক্কিও হয়। তিনি বলেন, ‘আমি অভিভাবকদের শান্ত করেছি। কেউ পিস্তল উঁচিয়ে ধরেছিল বলে আমার জানা নাই। ’
আহত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যালয়ে এসে আমাদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের কারো বাচ্চাই পড়ে না। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা মজিদের বাহিনীর লোক বলে এলাকায় পরিচিত। এদের ভয়ে এলাকায় কেউ কথাও বলতে পারে না। সেই বাহিনীর সদস্যরাই আমাদের ওপর হামলা করেছে। ’
ওই এলাকার বাসিন্দা ও দাওকান্দি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বিদ্যালয়টিকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই সবার মতামত নিয়ে একটি নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ’
জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয় লোকজন ও অভিভাবকরা মিলে ওই বিদ্যালয়ে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মজিদ ও তাঁর লোকজন ওই কমিটি মানবে না। এ কারণেই তারা বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা করেছে বলে শুনেছি। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/04/06/483373