১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৯

টিকে থাকার চেষ্টা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের

মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার রজনীগন্ধা টাওয়ারে মোবাইল ফোনের দোকান ছিল গোপালগঞ্জের বাসিন্দা নয়নের। গতবছর করোনার সময় লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল দোকানটি। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। ৩-৪ মাস পর দোকান খুললেও বিক্রি না থাকায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বরং আরও লসের মুখে পড়েন এই ব্যবসায়ী। পরে উপায় না পেয়ে মার্কেটের দোকানটি বন্ধ করে দিয়ে রাস্তার পাশে একটি ছোট দোকান ভাড়া নেন। কিন্তু আগের মতো ব্যবসা না থাকায় লাভ তো দূরের কথা বছরজুড়েই লসের মুখে পড়েন। চলতি বছর নতুন করে কিছু প্রোডাক্ট উঠিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

তবে আবারো লকডাউনে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েন। একমাত্র আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয় তার। এমন পরিস্থিতিতে অভাবে পড়ে অনেকের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়েছে তাকে। তবে শত চেষ্টা করেও নিজের ব্যবসাটি আর টিকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। সর্বশেষ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ছোট দোকানটিও বিক্রি করে দিয়ে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে তাকে। শুধু নয়ন নন, করোনার ধাক্কায় দেশের এমন লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মহাসংকটের মধ্যে পড়েছেন। চলমান লকডাউনে ব্যবসা বন্ধ করে বেশির ভাগই গ্রামে ফিরে গেছেন। ব্যতিক্রম দুই একজনের বিকল্প ব্যবস্থা হলেও অধিকাংশই ব্যবসা হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
সরজমিন দেখা গেছে, চলমান লকডাউনের কারণে রাজধানীর ফার্মগেট, গ্রীন রোড, পান্থপথ, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর এলাকার মার্কেট, শপিংমল এবং দোকানগুলো সব বন্ধ। এ ছাড়া এসব এলাকার রাস্তার পাশে ফুটপাথে বসে ব্যবসা করে সংসার চালাতেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। লকডাউনে এখন সব বন্ধ। সংকটে পড়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন অনেকে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় একদিকে লোকসানে মালিকরা, অন্যদিকে কর্মচারীরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে শহর ছেড়েছেন। এমনিতেই মহামারির কারণে গত বছর থেকেই ব্যবসায় মন্দাবস্থা। এ বছর আবারো করোনার ধাক্কায় নতুন করে মহাসংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬। এসব ব্যবসায়ী প্রতিবছর বৈশাখ, রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেন। গত বছর করোনার কারণে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। এ বছর আবারো লকডাউনে এসব ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন আহমেদ। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ফুটপাথে ব্যবসা করা অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন ব্যবসা বন্ধ করে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, তেমনি দোকানকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন মহাসংকটে। ব্যবসায়ীরা মূলত ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার টার্গেট থাকে। কিন্তু গত বছরের মতো এবারো দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ থাকায় পহেলা বৈশাখ, রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্য থেকে লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বঞ্চিত হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়ে পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা ছেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
মিরপুর ১০ নম্বরে ফুটপাথে বসে চামড়ার ব্যাগসহ মেয়েদের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন সানোয়ার। কিন্তু লকডাউনে এখন সব বন্ধ। তাই পরিবার চালাতে বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাঁচা তরকারির ব্যবসা। ভ্যানে করে বিভিন্ন গলির ভেতর ঘুরে তিনি কাঁচা তরকারি বিক্রি করেন। কিন্তু ভাড়ায় ভ্যান নিয়ে ব্যবসায় তেমন আয় হচ্ছে না। বিক্রিও কম। খরচ বাদ দিয়ে সারা দিনে মাত্র ২০০-৩০০ টাকা আয় হচ্ছে। ফলে সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পথে বসতে হবে বলে জানান তিনি।

মিরপুরের আরেক বাসিন্দা বিএ পাস করা তওহীদুল ইসলাম ২০১১ সালে মাত্র ১৬০০ টাকা দিয়ে শুরু করেন রেডিমেট গার্মেন্টস পোশাকের ব্যবসা। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এসবি এন্টারপ্রাইজ নামে নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ১৬০০ টাকা পুঁজিতে শুরু করা ব্যবসা দাঁড়ায় ১২-১৩ লাখ টাকায়। এ থেকে প্রতি মাসে তার আয় হতো ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। কিন্তু গত বছর থেকে করোনার কারণে মন্দা অবস্থায় পড়ে তার ব্যবসা। করোনার শুরুর দিকে লকডাউনের কারণে অনেকদিন ব্যবসা বন্ধ ছিল। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। পরে ব্যবসা চালু হলেও সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠাও সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে একটি এনজিও থেকে ২ লাখ টাকা লোন নিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। যদিও আগের মতো স্বাভাবিক ক্রয়-বিক্রয় ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনের কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকায় নতুন করে সংকটে পড়েছেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পড়েছেন মহাবিপদে। মাসে এক লাখ টাকা আয় করা এই ব্যবসায়ী এখন প্রায় নিঃস্ব। আপাতত ধারদেনা করে কোনোমতে সংসার চলছে তার। রয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকার ঋণের বোঝা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তার ব্যবসা বিক্রি করে দিতে হতে পারে বলে জানান তিনি। বলেন, এখন যে অবস্থা যাচ্ছে তাতে ঢাকা শহরে টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=282896&cat=2