১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৭

আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রকল্প

নিয়মের বাইরে ১৯ কোটি টাকা খরচ

৯৬ শতাংশ সময় শেষ অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ; কাজ না করলেও ঠিকাদারকে বিল প্রদান

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মগুলো রোধ করা যাচ্ছে না। মেগা থেকে ছোট সব প্রকল্পেই বিভিন্নভাবে প্রকল্পের অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিসেস রিজিওনাল প্রজেক্ট : পানি বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য সেবা ও আগাম সতর্কীকরণে ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ (কম্পোনেন্ট-বি প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি চলছে ঢিমেতালে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করে গাড়ি কেনা, বিএম স্তম্ভের অঙ্কন ও নকশা লঙ্ঘনের জন্য ওভার পেমেন্ট, সার্ভে বোট ও ক্যাটারমারানস ক্রয়ের জন্য নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদান, ক্রয়কৃত ভিডিও কনফারেন্স এবং অন্যান্য সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা, মরফোলজিক্যাল সার্ভে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে বিল দেয়া, ত্রুটিপূর্ণ সাব-বটম প্রোফাইল সরবরাহের পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে বিল প্রদান, কাজ না করলেও ঠিকাদারকে নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা প্রদানের অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসবে প্রায় ১৯ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়েছে খোদ আইএমইডির চোখে।

প্রকল্পের পটভূমির তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নদীবাহিত বন্যা, আকস্মিক বন্যা, বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা এবং সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন, পানি সম্পর্কিত অন্যান্য দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন, হাইড্রোলজিক্যাল মনিটরিং নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করার জন্য এই প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। পাঁচ বছরমেয়াদি এই প্রকল্পের অনুমোদিত খরচ ছিল ৩৪০ কোটি ৬৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা; যার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৩১৮ কোটি ৬০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পটি সারা দেশে বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
প্রকল্পের অধীনে কাজগুলো হলো- দেশব্যাপী ৩০৮টি ম্যানুয়াল পানি সমতল পরিমাপক স্টেশন টেলিমিটারিং যন্ত্রপাতি স্থাপন, ২৫৭টি বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্রের অটোমেশন, পাউবো পরিচালিত ৩টি আবহাওয়া স্টেশন আধুনিকায়ন, ৯০৫টি ভূগর্ভস্থ পানি সমতল স্টেশন অটোমেশন, বিভিন্ন প্রকার হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা, উপকূলীয় ৪০টি জলোচ্ছ্বাস স্টেশন স্থাপন, পাউবোর আইসিটি সিস্টেম আপগ্রেডেশন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পরামর্শক নিয়োগ।

প্রকল্পের কাজে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের জন্য দু’টি গাড়ি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করে ৪৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা লোকসান দেয়া হয়েছে। বিএম স্তম্ভের অঙ্কন ও নকশা লঙ্ঘনের জন্য ওভার পেমেন্ট হিসেবে ১৭ লাখ ৯৪ হাজার ৭১২ টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। সার্ভে বোট ও ক্যাটারমারানস ক্রয়ের জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে দুই কোটি চার লাখ ৮০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। পাঁচ কোটি ২৬ লাখ ১৭ হাজার ১৭০ টাকায় ক্রয়কৃত ভিডিও কনফারেন্স এবং অন্যান্য সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বলে উল্লেখ করেছে আইএমইডি। মরফোলজিক্যাল সার্ভে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে ছয় কোটি ৬৮ লাখ ৭২ হাজার ৪০০ টাকা দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ সাব-বটম প্রোফাইল সরবরাহের পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে তিন কোটি ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিল প্রদান করা হয়েছে। কাজ না করলেও ঠিকাদারকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৬৫ লাখ ২৭ হাজার ১৬৫ টাকা প্রদান করা হয়েছে। ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট দেয়ার আগেই নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৪ লাখ সাত হাজার ২৬৩ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের তথ্যানুযায়ী, সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ৬৩টি প্যাকেজের পরিবর্তে বর্তমানে ৫৫টি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পণ্যের প্যাকেজ ২৩টির পরিবর্তে ২০টি এবং পরামর্শক সেবার প্যাকেজ ২২টির পরিবর্তে ১৭টি করা হয়েছে। পূর্ত কাজের পাঁচটি প্যাকেজের মধ্যে সবগুলোর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র দুইটি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়ছে। বাকি তিনটি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। পণ্য সংক্রান্ত ২০টি প্যাকেজের মধ্যে এ পর্যন্ত (এপ্রিল-২১) ১৯টির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বাকি ছয়টি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। পাশাপাশি নন-কনসালটেন্সি সার্ভিস ১৩টি প্যাকেজের মধ্যে ১০টি প্যাকেজের কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। এসবের মধ্যে চারটি সমাপ্ত এবং ছয়টি চলমান আছে। পরামর্শক সেবার ১৭টি প্যাকেজের মধ্যে ১৩টির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও ৯৬ শতাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে অথচ বাস্তবে কাজ হয়েছে ৪৩ শতাংশ আর আর্থিক অগ্রগতি ২৫.৮৫ শতাংশ। ২০২১ সালেও প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ নাই বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। জনবলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নও সন্তোষজনক নয়। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রকল্পের অধীনে কিছু রিভার পরিমাপক এমন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে, যা বর্ষার সময় নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ রিডিং নিশ্চিতকরণের নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট জায়গায় হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতিগুলো স্থাপন করা উচিত। প্রকল্পের অঙ্গ পরামর্শক নিয়োগের এ পর্যন্ত (এপ্রিল) ভৌত অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ। প্রকল্পে গবেষণা বা উদ্ভাবন খাতে ২২ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হলেও বাস্তব অগ্রগতি ১.৩৯ শতাংশ। কারিগরিভাবে জটিল এই প্রকল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ জনবলের সঙ্কট রয়েছে। জনবলের অভাবে দেশব্যাপী এই প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে।

কাজের অগ্রগতির বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের এপ্রিল-২০২১ পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৯০৫টি ভূগর্ভস্থ পানি সমতল স্টেশন অটোমেশনের মধ্যে ৩৭০টির কাজ চলমান আছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ৩৭০টির মধ্যে ৫০ শতাংশ স্টেশন পর্যবেক্ষণের জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। দেশব্যাপী ৩০৮টি ম্যানুয়াল পানি সমতল পরিমাপক স্টেশন টেলিমিটারিং যন্ত্রপাতি স্থাপন, ২৫৭টি বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্রের অটোমেশন, পাউবো পরিচালিত তিনটি আবহাওয়া স্টেশন আধুনিকায়ন, উপকূলীয় ৪০টি জলোচ্ছ্বাস স্টেশন স্থাপনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এখনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন সম্পন্ন হয়নি। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ।

সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বলছে, কাজ বাস্তবায়নে সেখানে কাঠের শাটার ও বাঁশের কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব কাজ পরিদর্শনে দেখা যায়, স্টিল শাটার ও জিআই পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পে স্থাপিত প্রায় ২০ শতাংশ বিএম পিলার, রেইন হেজ, অটোমেশন যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখা যায়, বেশির ভাগই ভালো অবস্থায় আছে। কিছু বিএম পিলার ও রেইন স্টেশন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি স্থাপনে দীর্ঘ সময়ের কারণে এবং ঠিকাদারের গড়িমসিতে কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। এখনো প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক জেলাতে যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্পন্ন হয়নি। সংস্থাটি বলছে, দক্ষ জনবলের অভাবে কাজ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম। এতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

প্রকল্প পরিচালক মশিউর রহমানের ফোনে গত বৃহস্পতিবার রাতে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে পাউবোর মহাপরিচালক বজলুর রশীদের ফোনেও যোগাযোগ করা হলে তাকেও পাওয়া যায়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/593978