১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৬

প্রিয়জনের খোঁজে মর্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা

বারো বছরের ছোট্ট হাসনাইনের খোঁজে মর্গের গেটে অপেক্ষার করছেন বোন তানিয়া। ছোট ভাইয়ের ছবি হাতে নিয়ে তার এ অপেক্ষার অন্ত নেই। কফিনের সাদা প্যাকেটে মোড়ানো লাশগুলো মর্গে রাখা। লাশগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে দেখে চেনার উপায় নেই। তবুও বোনের অপেক্ষা ভাইয়ের লাশটি অন্তত খুঁজে পাওয়ার। দুই মাস আগে ওই কারখানার চারতলার সেমাই সেকশনে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে হাসনাইন। গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। থাকত ওই কারখানার মেসে। হাসনাইনের দুলাভাই আব্বাস অগ্নিকাণ্ডের দিন বৃহস্পতিবার রাত থেকে কারখানার বাইরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু রাত গড়িয়ে গতকাল শুক্রবার সকালেও কোনো অবস্থায়ই হাসনাইনকে পাননি তিনি। পরে পালা করে একেক জন একেক জায়গায় খুঁজতে থাকেন। আব্বাস ওই কারখানার ও আশপাশের হাসপাতালের দায়িত্বে, তার খালা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে, আরেক আত্মীয় ঢাকা মেডিক্যালে আর বোন তানিয়ার ভাগে পড়ে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে। এভাবে ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন স্থানে হাসনাইনকে খুঁজেও গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত তার সন্ধান পাননি স্বজনরা। সরকারি বিধিনিষেধে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দীর্ঘ পথ হেঁটে হাঁপিয়ে উঠেছেন স্বজনরা। কেউ কনক্রিটের ওপর বসে, কেউ পাকা রাস্তার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছেন, প্রিয় স্বজনের জন্য। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ হওয়া স্বজনের অপেক্ষায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনের চিত্র ছিল এমন।

কারখানার পোড়া ধ্বংসস্তূপে, বিভিন্ন হাসপাতালে, বার্ন ইনস্টিটিউটের পোড়া রোগীদের মধ্যে খুঁজে না পেয়েও সর্বশেষ আসছেন মর্গে। যেখানে কোনোভাবেই স্বজনকে পেতে চান না আগত স্বজনরা। তবুও অপ্রত্যাশিত জায়গায় প্রিয়জনের দেহাবশেষটুকু শনাক্ত করে নিজ চোখে দেখে নিজকে বুঝ দিতে এত কিছু। কেউ এসেছেন সন্তানের খোঁজে, কেউ ভাইয়ের খোঁজে, কেউবা ভাগ্নের খোঁজে মর্গের গেটে এসে এভাবে হাঁপিয়ে উঠেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। মর্গের সামনের গলির দেয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুরো মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেছে তানিয়ার। রূপগঞ্জে আগুনের ঘটনায় মর্গে আপনার কেউ আছেন কি না? এই প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে হকচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ান তানিয়া। যেন শক্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি। তানিয়া ভেবেছিলেন, হয়তো এই প্রতিবেদক হাসপাতাল কিংবা মর্গের কেউ এবং তার ভাইয়ের খোঁজ দিতে পারবেন। কিন্তু পরক্ষণে তিনি এক প্রকারে নিরাশ হয়ে যান, আস্তর খসে পড়া এবড়োথেবড়ো দেয়ালের সাথে পিঠটা একটু হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেন। কারণ ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে আর তার তথ্য জানাতে জানাতে এক প্রকারে ক্লান্ত তানিয়া।
ওই কারখানায় রাকিব (১৭) নামে তার এক চাচাতো ভাইও কাজ করত। ঘটনার পর থেকে তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকেও খুঁজছেন তানিয়ারা।

সেজান জুস কারখানায় ছয় মাস আগে চাকরিতে ঢোকেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মঞ্জুরুল হাসান। পরে দুই মাস আগে মঞ্জুরুল তার ভাগ্নে সাজ্জাদ হোসেন সজীবকে (২০) ছয় হাজার টাকা বেতনে হেলপার হিসেবে কাজে ঢোকান। এইচএসসি পাস করার পর পরিবার আর্থিক অনটনে থাকায় ছাত্র জীবনেই সজীবকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। তারা (সজীব ও মঞ্জুরুল) মামা-ভাগ্নে চারতলায় কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডে মঞ্জুরুলকে পাশের ভবনের লোকজন জানালা ভেঙে বের করলেও সজীবের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গতকাল মর্গে ভাগ্নের খোঁজে আসেন সজীবের আরেক মামা মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, আগুন লাগার ৫ মিনিট আগে সজীব মঞ্জুরুলকে জানিয়ে নাশতা খেতে বাইরে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়। এর পরই হঠাৎ চার দিক কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। জ্ঞান হারায় মঞ্জুরুল। পরে ভবনের লোকজন তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু সজীবের কোনো খোঁজ মিলছে না। তার ফোনও বন্ধ। আগুন লাগার আগে সে নিচে নামতে পারলে নিশ্চয় তাকে পেতাম। মনে হয়, সজীব সিঁড়িতে থাকাবস্থায় আগুন লাগে। এতে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি, আশঙ্কা মাহফুজুরের।

হাতিয়ার নাছিরপুর গ্রামের ইউসুফের ছেলে মাইনুদ্দিনকে (২১) খুঁজতে মর্গে আসেন মামা ইব্রাহিম; নেত্রকোনার মহনগঞ্জ থানার সেকুপুর গ্রামের মৃত জাকির হোসেনের মেয়ে শান্তা মনি আক্তারের (১৬) সন্ধানে আসেন মামা জামিরুল ইসলাম হিমেল; ভোলার চরফ্যাশনের গোলাম হোসেন মাঝির ছেলে মহিউদ্দিনকে (২৭) খুঁজতে টঙ্গী থেকে ছুটে আসেন বোন তাসনুর বেগম। এমন অসংখ্য প্রিয়জনের খোঁজে মর্গে এসে ভিড় করেন স্বজনরা। কিন্তু কেউ তাদের প্রিয়জনের তথ্য জানাতে পারেনি। কেননা আগুনে লাশগুলো পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে দেখে চেনারও উপায় নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে তাদের।

ঘটনার দিন ওই কারখানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজন নিহত হন। আর গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত ৪৯ লাশ উদ্ধারের পর মোট ৫২ লাশ আনা হয় ঢামেক মর্গে। এদের মধ্যে ৪৯ লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই পুড়ে যাওয়া ৪৯ লাশ যথাযথ প্রক্রিয়ায় ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করা হবে বলে গতকাল ঢাকা মেডিক্যালে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, সব লাশ আগুনে পুড়ে ঝলছে গেছে। প্রয়োজনে তাদের লাশ ফ্রিজিং করা হবে। আত্মীদের সাথে ডিএনএ স্যাম্পল মিলিয়ে পরবর্তীতে লাশ হস্তান্তর করা হবে। তবে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/593994/