১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৫

হাসপাতালের সামনে বাড়ছে শ্বাসকষ্টের রোগীদের ভিড়

ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ডেডিকেটেড নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। এতে চারজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে এসব রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যান। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে সাধারণ রোগী ও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা রোগীর জন্য অক্সিজেনের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। একইসাথে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বাড়ছে। বিশেষ করে করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশের জেলাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে একের পর এক রোগী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আসছেন। আবার অনেক রোগী চিকিৎসা নিয়ে চলেও যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট বেশি স্পর্শকাতর হওয়ায় রোগীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে খুব দ্রুত। এজন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেলসহ করোনার জন্য নির্ধারিত মেডিকেলগুলোতে প্রতিনিয়ত শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল শুক্রবারও ঢাকা মেডিকেল থেকে অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বাধ্য হয়ে অন্য মেডিকেলে আবার কেউ প্রাইভেট হাসপাতালে চলে গেছেন।
ঢাকা মেডিকেলের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় অনেক রোগীরই আইসিইউ বেডের প্রয়োজন হয়, কিন্তু সিরিয়াল দিয়েও বেড না পেয়ে কেউ কেউ প্রাইভেট হাসপাতালে যাচ্ছেন। ঢামেকের নতুন ভবনের করোনা ইউনিটে ভর্তির কাউন্টারে দায়িত্বরতরা জানিয়েছেন, ভর্তি বেশিরভাগ রোগীই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। অনেক রোগীই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে আসলেও ভর্তির সময় তাদের ঠিকানা ব্যবহার করেন ঢাকায় থাকা আত্মীয়ের। তারা বলছেন, ভর্তি রোগীদের মধ্যে অনেকের আইসিইউর প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে একটি বেড ফাঁকা হলেই সিরিয়ালে থাকা এখানকার রোগীকে দেওয়া হয়।

একই অবস্থা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজ হাপসাতালেও। গতকাল মেডিকেলের সামনে অনেক রোগীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অসহায় রোগীরা অক্সিজেন চাচ্ছিলেন এবং ভর্তি হওয়ার জন্য সংবাদকর্মীদের কাছেও সাহায্য চাইছিলেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। আমাদের এখানে ভর্তি দুই শতাধিক করোনা রোগী। যাদের কাউকেই আমরা শঙ্কামুক্ত বা কম শঙ্কামুক্ত বলছি না। সবারই কম-বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে শ্বাসকষ্ট যাদের নেই, এমন করোনা আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি নিতে পারছি না। তাদের পরামর্শপত্র দিয়ে বাসা থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি। আমাদের এখানে করোনা রোগীর জন্য বরাদ্দ করা ১০ আইসিইউ বেডই এখন পূর্ণ। নতুন করে কাউকে সেখানে স্থানান্তর করাও সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। তাদের সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারছেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দায়িত্বরতরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দুই শতাধিক করোনা রোগী এইমুহূর্তে ভর্তি আছেন। তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। সবারই কম-বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে। অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে না বা শ্বাসকষ্ট নেই এমন করোনা রোগীকে হাসপাতালটিতে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।
গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে অনেক হাসপাতালে। হাসপাতালগুলোতে সংকুলান না হওয়ায় এ কাজটি করা হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা দেন সরকারী হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, যাদের অবস্থা খুব বেশি খারাপ তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। আর বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না একারণে যে, ভর্তি হওয়ার দুই তিন দিনের মধ্যেই তাদের আইসিইউ লাগে। পরে তাদের আর আইসিইউ দেওয়া সম্ভব হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে যাদের সরকারী হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়; পরবর্তীতে তাদের কী পরিণতি হয় তার খবর কি কেউ রাখে ?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর ঝুকিপূর্ণ ভেবেই হাসপাতালে নিয়ে দৌড়ান স্বজনরা। পরে যখন সরকারী হাসপাতাল থেকে ফেরত পাঠানো হয় তখন তারা বেসরকারী হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর সেখানে নেওয়া সামর্থ না থাকলে বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে যেতে হয়। আর বাসায় ফিরে গিয়ে যদি উপযুক্ত চিকিৎসা না পান তাহলে বলা যায় মানুষটি বিনা চিকিৎসাতেই মরতে হয়।
সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শুক্রবার দেশে আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। যে পরিমাণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তাদের সবাইকে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়া দুরূহ ব্যাপার। সেই সক্ষমতা এবং জনবল নেই দেশে।
পরিসংখ্যান বলছে, হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৮ বিভাগে মোট করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা ১২ হাজার ৩৪৭টি, মোট আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৯২ টি। আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা মহানগর হাসপাতালগুলোতে মোট জেনারেল বেড সংখ্যা ৫ হাজার ৬২৬টি। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে সরকারি ১৩টি এবং বেসরকারি ১৩টি হাসপাতাল রয়েছে। ঢাকা মহানগরের ১৩টি করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৭০৫টি বেড।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ১০টি জেনারেল বেড। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ১৩৭টি জেনারেল বেড। টিবি হাসপাতালের ২০০টি জেনারেল বেড। রয়েছে পাঁচটি আইসিইউ বেড। ডিএনসিসি হাসপাতালের ২০০টি জেনারেল বেড। এখানে রয়েছে মোট ১০০টি আইসিইউ বেড।
এসব বেড আগেই পূর্ণ হয়ে আছে। এসব সিট ফাঁকা হয় কেবল কেউ মারা গেলে অথবা সুস্থ হয়ে উঠলে। তাই নতুন রোগীদের অপেক্ষায় থাকতে হয় কোন সময় বেড খালি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬ বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছে। সরকারি এই ৭টি হাসপাতালের ১১২টি বেডেই রোগী ভর্তি রয়েছে।
এদিকে কোন বেড ফাঁকা হওয়ার আগেই প্রভাবশালী মহলের তদবির থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। এসব বিবেচনায় সাধারণ রোগীদের বেড পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২১২ জন। দেশে মহামারিকালে একদিনে এত মৃত্যু এই প্রথম দেখল বাংলাদেশ। এর আগে গত ৭ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ ২০১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার পরদিন ৮ জুলাই ১৯৯ জনের মৃত্যুর কথা জানালেও আজ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা নতুন রেকর্ড করলো। সরকারী হিসেবে বলা হচ্ছে গতকাল বাড়িতে মারা গেছেন গেছেন ১৬ জন।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেনের প্রতিদিনের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আড়াইগুণ বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিনের চাহিদা ৫০ থেকে ৭০টন হলেও বর্তমানে চাহিদা আড়াই থেকে তিনগুণের কাছাকাছি। এখনও পর্যন্ত চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেনের চাহিদা মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগৃহীত হয়েছে ৩৮ হাজার ২৪টি, আর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৫০টি। দেশে এখন পর্যন্ত করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৮ লাখ ৬৬ হাজার ৬৮২টি। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা করা হয়েছে ৫০ লাখ ২১ হাজার ২২১টি এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা করা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬১টি।

https://dailysangram.com/post/458163