১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৩

শাহ্ আব্দুল হান্নানের অপ্রকাশিত লেখা

ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতার ভিত্তি ও প্রকৃতি

তিনটি বিষয় মানবসভ্যতাকে বিভক্ত করে রাখে। মানবজাতির সংহতি বিনষ্ট করে। একটি হচ্ছে বর্ণবাদ, কালো মানুষ ও সাদা মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা। এটি একেবারেই অযৌক্তিক। মানুষ রঙ নির্বিশেষে মূলত এক। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মূলত একই রকম। তাদের স্রষ্টা একই স্রষ্টা। কুরআনে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন রঙ সৃষ্টি আল্লাহর সৃষ্টিকৌশলের অংশ। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনিভাবে সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

এ সত্ত্বেও ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে কালো মানুষ ধরে আনে এবং তাদের দাস বানায়। সে এক অবর্ণনীয় দুঃখের কাহিনী। যেসব দাস ধরা হতো তাদের জাহাজে করে আমেরিকায় আনা হতো। যেভাবে তাদের অত্যাচার করা হতো তা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। এ কাজ করেছিল সাদা মানুষেরা যারা ইউরোপ থেকে আমেরিকা গিয়েছিল। সেখানে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করে, অন্যদিকে আফ্রিকা থেকে দাস ধরে আনে। তাদের দাস বানায়। তাদের কোনো মানবাধিকার ছিল না।
আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রচেষ্টায় আমেরিকায় আইনগতভাবে দাসপ্রথার অবসান হয়। কিন্তু বাস্তবে দাসপ্রথা চলতে থাকে। দাসপ্রথা বিলোপের সিদ্ধান্তের ওপর আমেরিকায় কয়েক বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধ হয়। বাস্তবে আমেরিকায় কালো-সাদার পার্থক্য আজো রয়েছে। বেশির ভাগ সাদার মনের মধ্যে এটি বদ্ধমূল হয়ে আছে।

এই বর্ণবাদের ভিত্তিতে কোনো সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না। সভ্যতার ভিত্তি হতে হবে সব মানুষের সমতা ও ঐক্য।

বর্ণবাদের পরে যে মতবাদ মানবজাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে তা হচ্ছে শ্রেণিসঙ্ঘাতের মতবাদ (Theory of Class War)। মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন আছে। সব মানুষ যাতে ভালোভাবে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু মানবজাতিকে ধনী-গরিব দু’-শ্রেণীতে ভাগ করা এবং দুটি শ্রেণীর মধ্যে চিরন্তন শ্রেণিসংগ্রাম আছে বলা বাড়াবাড়ি। কমিউনিজম তা-ই করেছিল। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তাদের হাতে কোটি কোটি লোক নিহত হয় রাশিয়ায় ও অন্যান্য রাষ্ট্রে। মধ্য এশিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ওপর রাশিয়া আরো বেশি নির্যাতন করে। তাদের ধর্ম পালনের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাদের মসজিদ ধ্বংস করা হয়। মসজিদের স্থানে পানশালা (Bar) করা হয়। কমিউনিস্টরা ধর্মকে আফিম বলে। তারা একপার্টি সরকার চায়। সবকিছু জাতীয়করণ করার ফলে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। শেষ পর্যন্ত এ কারণেই কমিউনিজমের পতন হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোথাও এখন কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় নেই। চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আছে কিন্তু সে রাষ্ট্র আসলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র নয়।

শ্রেণীর ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে এরকম মতবাদ দ্বারা আদর্শ বিশ্বসভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না। তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

তৃতীয় যে মতবাদ মানবজাতিকে বিভক্ত করেছে তা হচ্ছে- জাতপাত ব্যবস্থা (Caste System)- মানুষকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রে ভাগ করা। যে ব্যবস্থা ভারতে আছে। এ ব্যবস্থা মানবঐক্যের সহায়ক নয়। এর ভিত্তিতে কোনো উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ভারতে এর বিরুদ্ধে বিশাল জনমত রয়েছে। যদিও এ ব্যবস্থা সমাজের গভীরে শিকড় গেঁড়ে আছে।
উপরোল্লিখিত তিনটি মতবাদের ভিত্তিতে উন্নত মানবিক সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের অন্য পন্থা অনুসন্ধান করতে হবে।

পাশ্চাত্য সভ্যতা কি আদর্শ সভ্যতা হতে পারে? এটি এখন আলোচনা করব। প্রত্যেক সভ্যতার একটি শরীর (Body) আছে। আর আছে এর আত্মা (Soul)। পাশ্চাত্য সভ্যতার শরীর খুব ভালো মনে হয়। অনেক দালান, অনেক শিল্প, অনেক উন্নতমানের রাস্তা ইত্যাদি। পাশ্চাত্য সভ্যতার শরীরটি ভালো। কিন্তু তার আত্মা পচে গেছে। আত্মা হচ্ছে তার সামাজিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ। পাশ্চাত্য সমাজে যৌন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা চলছে। পরিবার ভেঙে গেছে। সমকামিতা বৈধ। শিশুরা অবহেলিত, বৃদ্ধরা অবহেলিত। আবার রয়েছে মাদকতা। ৯০ শতাংশ লোক মাদকাসক্ত। কফিশপেও হেরোইন পাওয়া যায়। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গ পায় না। তারা কুকুর নিয়ে বাস করে। সেখানে হত্যা, আত্মহত্যা, সশস্ত্র হামলা (Gun Violence) অনেক বেশি।

সুতরাং, পাশ্চাত্য সভ্যতা আগামী সভ্যতার ভিত্তি হতে পারে না। ডক্টর ইউসুফ আল কারযাভী তার ‘ভবিষ্যতের সভ্যতা’ গ্রন্থে এ কথাই বলেছেন। তার মতে, ইসলামই সে ব্যবস্থা যা ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতার ভিত্তি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে তাওহিদ- স্রষ্টা এক আর সব সৃষ্টি। এর মধ্যে রয়েছে ‘ধর্মে জবরদস্তি না করার’ বিধান। এর মধ্যে রয়েছে সার্বিকভাবে সবার প্রতি সুবিচার (জাস্টিস) প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে রয়েছে অসহায়দের জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা এবং যে ব্যবস্থায় সরকার সব অসহায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
আমি মনে করি, ড. ইউসুফ আল কারযাভী সঠিক কথা বলেছেন। মানবজাতি যদি চিন্তা করে কাজ করে এবং মুসলিমরাও দায়িত্ব পালন করে তাহলে ইসলামই হবে ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতা।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/593882