৯ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৮

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

পাইলট নিয়োগে ফের কেলেঙ্কারি বিমানে

বিমানে ৩৪ জন পাইলট নিয়োগে বড় ধরনের দুর্নীতির রেশ না কাটতেই ফের নতুন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

এবার নিয়োগের জন্য ভুয়া ফ্লাইট শিডিউল ঘোষণা করে প্রথমে পাইলটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। গত ১৫ জুনের পর পর্যায়ক্রমে নিয়োগ দেওয়া হয় ৬ জনকে।

আরও ৪৩ জনের নিয়োগ নিয়ে তোড়জোড় চলছে। যেসব স্টেশনে বিমান চলে না, সেখানেও ফ্লাইট দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে টরেন্টো, নারিতা ও চেন্নাইয়ের নাম রয়েছে।

এসব স্টেশনে সপ্তাহে ৩ থেকে ৭টি করে ফ্লাইট দেখানো হয়েছে। এছাড়া বন্ধ থাকার পরও ৬/৭টি স্টেশনে ভুয়া ফ্লাইট চলমান দেখিয়ে কৃত্রিম পাইলট সংকট তৈরি করা হয়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর আগে পাইলট নিয়োগ নিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারির ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের এই কেলেঙ্কারি বিমানকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলতে পারে।

তারা এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। একই সঙ্গে আগের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা জনসম্মুখে জানানোর দাবি জানান।

পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) এই ‘কৃত্রিম সংকট’, ‘ভুয়া ফ্লাইট শিডিউল’ ঘোষণা এবং বিমানের নিজস্ব পাইলটদের বসিয়ে রেখে বাইরে থেকে নিয়োগ বন্ধে বিমানকে একাধিক চিঠি দিয়েছে।

কিন্ত কর্ণপাত করেনি ম্যানেজমেন্ট। উলটো বিমান প্রশাসন বিভাগ থেকে পাইলটদের নানাভাবে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়।

বাপা সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান এসব অভিযোগের বিষয়ে বিমান ম্যানেজমেন্টকে বহুবার চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জানা যায়, বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ক্যাপ্টেন এবিএম ইসমাইল ১৪ জুন এক চিঠিতে ভুয়া শিডিউল ঘোষণার বিরুদ্ধে বিমান ম্যানেজমেন্টকে চিঠি দিয়েছেন।

এতে তিনি লিখেছেন, টরেন্টো, নারিতা, চেন্নাইয়ে এখনো ফ্লাইট অপারেশন শুরু হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালের সামার শিডিউলে এসব স্টেশনে ফ্লাইট পরিচালনা নিয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে ক্যাপ্টেন ইসমাইলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার টেলিফোনে চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তার অফিস (ফ্লাইট অপারেশন) থেকে বলা হয়েছে তিনি ফ্লাইটে আছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তৎকালীন এমডিসহ ১০ কর্মকর্তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তাদের অধিকাংশই এখন বিমানে নেই।

এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিমানের প্রশাসন বিভাগ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কয়েক বছর ধরে বিমানের সব নিয়োগে প্রশাসন বিভাগ মুথ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতোমধ্যে অন্য নিয়োগ নিয়েও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, এবারের নিয়োগ বাতিল ও নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পাইলটদের সংগঠন বাপার পক্ষ থেকে বিমানকে লিখিতভাবে জানানো হয়।

এর মধ্যে ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন, ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, চলতি বছরের ৬ জুন বিমানের এমডি ও সিইও এবং ২২ জুন বিমান পরিচালনা পর্যদ চেয়ারম্যান, ৪ মার্চ বিমানের পরিচালক প্রশাসন, ১৫ জুন বিমান এমডিকে দেওয়া চিঠিগুলো যুগান্তরে এসে পৌঁছেছে।

এসব চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কীভাবে বিমানের পাইলটদের বসিয়ে রেখে এবং ট্রেনিং না করিয়ে সংকট তৈরি করা হচ্ছে।

এছাড়া একদিকে বিমানের অভিজ্ঞ পাইলটদের চাকরির বয়স শেষে চুক্তি না বাড়িয়ে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে বাইরে থেকে অদক্ষ ও বয়স্কদের বেশি বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

বাপার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিমান পাইলট সংকট ও ফ্লাইট শিডিউল নিয়ে তৈরি করা তথ্য মনগড়া ও মিথ্যা। কিন্তু এরপরও বিমান ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিয়োগ অনুমতি বাগিয়ে নিতে সিন্ডিকেট যেসব দেশে বিমানের ফ্লাইট নেই, সেসব দেশেও ভুয়া ফ্লাইট দেখিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ‘সামার শিডিউল’ ঘোষণা করে।

কানাডার টরেন্টো, জাপানের নারিতা, ভারতের চেন্নাইয়ে বিমান কোনো ধরনের ফ্লাইট পরিচালনা করেনি। কিন্তু সামার শিডিউলে এসব দেশে সপ্তাহে ৩ থেকে ৭টি করে ফ্লাইট দেখানো হয়েছে।

কুয়েতে সাড়ে ৩ বছর ধরে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ। কিন্তু সেখানেও সপ্তাহে ৪টি ফ্লাইট দেখানো হয়েছে। করোনার কারণে গত ২ বছর মদিনায় ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ থাকলেও সেখানে দেখানো হয়েছে ৪টি ফ্লাইট।

লন্ডনের ম্যানচেস্টার শহরে দীর্ঘদিন ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ থাকলেও সেখানে দেখানো হয়েছে সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট। এছাড়া দোহা, আবুধাবি ও মাসকটে সপ্তাহে ১৪ ফ্লাইট দেখানো হলেও বাস্তবে এসব স্টেশনে অর্ধেক ফ্লাইটও নেই।

সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে-এই তিন স্টেশনে একই দিনে ও একই সময়ে একটি বোয়িং ৭৭৭ এবং একটি বোয়িং ৭৩৭ এয়ারক্রাফটের ফ্লাইট দেখানো হয়েছে।

এছাড়া কাঠমান্ডু ও কলকাতায় করোনার কারণে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ থাকলেও এ দুই গন্তব্যে দেখানো হয়েছে সপ্তাহে ৭টি করে ফ্লাইট।

জানা যায়, ওই শিডিউলের তথ্য উল্লেখ করে প্রশাসন বিভাগ থেকে বিমান ম্যানেজমেন্টকে বলা হয়, বর্তমানে ‘সামার শিডিউল’ অনুযায়ী বিমানে ২০৩ জন পাইলট প্রয়োজন।

এর মধ্যে বিমানের নিজস্ব পাইলট আছেন ১৫২ জন। বাকি ৫১ জন পাইলট সংকটের কথা উল্লেখ করে দ্রুত নিয়োগের অনুমোদন চাওয়া হয়।

অনুমোদন পাওয়ার পর গত ১ জুন ড্যাস-৮কিউ৪০০ উড়োজাহাজের পাইলট নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ১৫ দিনের মধ্যে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কথা বলা হয়।

সাধারণত যে কোনো নিয়োগে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর সব আবেদন যাচাই-বাছাই করে প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি জানিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে-এই নিয়োগে তড়িঘড়ি করে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আবু সালেহ মোস্তফা কামাল সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। তার মোবাইল ফোনে লিখিত আকারে প্রশ্ন পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন বিভাগ। কাজেই এ প্রসঙ্গে জানতে বিমানের পরিচালক প্রশাসন জিয়া উদ্দিন আহম্মেদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন ধরেননি।

তার অফিসে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, তিনি আরও একটি বিভাগের (প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট) পরিচালক হিসাবে দায়িত্বে থাকায় সব সময় ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে হয়তো ফোন ধরতে পারেন না।

জানা গেছে, গত বছর করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তবে চ্যাটার্ড ও নন শিডিউল ফ্লাইটের মাধ্যমে বিমান কিছু ফ্লাইট পরিচালনা করে।

এর মধ্যে এপ্রিলে বিমান ফ্লাইট চালায় ১৮টি। মে মাসে ৫৪টি, জুনে ৭৩টি, জুলাইয়ে ২৬৭টি এবং আগস্টে সর্বোচ্চ ৪১২টি। করোনার প্রথম ঢেউ কিছুটা কমে গেলে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ফের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্বাভাবিক হয়।

ওই মাস থেকে গড়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে বিমান। কিন্তু করোনার কারণে সম্প্রতি আবারও বেশির ভাগ স্টেশনে ফ্লাইট বন্ধ আছে।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিমানে ৫৬ জন পাইলট সিমিউলেটরসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্টের ট্রেনিং নিয়ে বসে আছেন। তাদের মধ্যে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ও বোয়িং ৭৩৭ এবং ড্যাস-৮কিউ ৪০০ এয়ারক্রাফটের পাইলট রয়েছেন।

এই ৫৬ জনকে সিমিউলেটরসহ বিভিন্ন ট্রেনিং দিতে বিমানকে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। নিয়ম হলো, সিমিউলেটর ট্রেনিং শেষ করে সব পাইলটকে সিভিল এভিয়েশনের কাছে রুট ট্রেনিং করতে হয়।

ওই ট্রেনিং পাশ করতে পারলেই তাদেরকে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সে ক্যাপ্টেন ও ফাস্ট অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

কিন্তু কৃত্রিম সংকট দেখানোর জন্য ট্রেনিং শেষ করা পাইলটদের রুট ট্রেনিং না করিয়ে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বিমানে ১৩ জন ক্যাডেট পাইলট বসে বসে বেতনভাতা নিচ্ছেন। তাদের কোনো ট্রেনিং করানো হচ্ছে না।

এছাড়া গত দুই বছরে বিমান থেকে কমপক্ষে ১০ জন পাইলটকে অবসর দেওয়া হয়েছে। এদের অধিকাংশই কম বেতনে চুক্তিভিত্তিক থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বিশেষ করে প্রশাসন বিভাগ থেকে এদের কাউকেই রাখা হয়নি।

২০২০ সালের ১৫ আগস্ট বিমানকে দেওয়া বাপা প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে বিমানে সব ধরনের পাইলট ট্রেনিং সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছে।

ভবিষ্যতে এটি বিমানের জন্য ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। কোনো ধরনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রেনিং করে আসা ২৬ জন পাইলটকে রুট ট্রেনিংয়ে পাঠানো হচ্ছে না।

অপরদিকে অনেক ফাস্ট অফিসার ট্রেনিং এবং রুট ট্রেনিং শেষ করার কারণে পাইলটদের সমান বেতন পাচ্ছেন। ট্রেনিং না থাকার কারণে অনেকে ঘরে বসে বসে বেতন নিচ্ছেন।

এ কারণে বাধ্য হয়ে বিমানকে বেশি বেতনে দেশি ও বিদেশি পাইলটকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হচ্ছে। অহেতুক তৈরি সংকটের কারণে বোয়িং ৭৩৭-এর পাইলটকে দিয়ে ড্যাস-৮ কিউ৪০০ উড়োজাহাজের ফ্লাইট করানো হচ্ছে।

নিয়োগকৃত একাধিক পাইলটের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ : জানা গেছে, নতুন নিয়োগ করা চুক্তিভিত্তিক ৬ পাইলটের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আছে। কিন্তু বিমান এসব অগ্রাহ্য করেছে।

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তাদের অনেকে চাকরি হারিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাদের কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করেছিল।

তাদের মধ্যে একজন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি হয়ে জেলও কেটেছেন। অন্য একজন কক্সবাজার বিমানবন্দরে একটি এটিআর এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনায় চাকরি হারিয়েছিলেন।

ওই এয়ারক্রাফটটি এখনো কক্সবাজার বিমানবন্দরে পড়ে আছে। এই দুর্ঘটনার কারণে ওই পাইলট চাকরি হারিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর একটি কার্গো বিমানের পাইলট হিসাবে যোগ দেন।

৩ জনকে একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তড়িঘড়ি করে বিমান তাদের নিয়োগ দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/440759/