৯ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৮

সরকারের চলমান ছয় উন্নয়ন প্রকল্প

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত

আইএমইডির প্রতিবেদন: ক্রয় আইন-বিধিমালা লংঘন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, পরিকল্পনা করা হয়নি বছরভিত্তিক আর্থিক ও ভৌত কাজের

সরকারের চলমান ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ক্রয় আইন ও বিধিমালা না মানা, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার, যথাযথ মনিটরিং না করা, ডিপিপি বা আরডিপিপি অনুযায়ী বছরভিত্তিক আর্থিক ও ভৌত কাজের পরিকল্পনা প্রস্তুত না করা।

এ ছাড়া তৈরি করা হয়নি ডিপিপিতে সংযুক্ত ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা। এমনকি পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মিত পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও পিএসসি (প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি) সভাও হয়নি। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (ইমপ্লিমেন্টেশন, মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুশন ডিভিশন বা আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।

বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্প তিনটির নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করা দুরূহ হবে। পাশাপাশি টেকসই বাস্তবায়নও হুমকিতে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্পগুলো হচ্ছে-‘ঢাকার মিরপুরে ৯নং সেকশনে ১৫টি ১৪ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’, ‘৬৪ জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ (প্রথম পর্যায়ে ২২ জেলা) প্রকল্প এবং ‘সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প। এ ছাড়া আছে ‘বিকেএসপি’র প্রমীলা প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নয়ন’, ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী স্থাপন প্রকল্প। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালার লংঘন বিষয়ে এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি। আইএমইডি’র এরকম প্রতিবেদন তৈরি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে তারা যেসব বিষয় চিহ্নিত করেছে সেগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কেননা আইনের চোখে সবাই সমান।

আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, আমরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। তারা যেসব তথ্য নিয়ে এসেছে সেগুলোর বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আবার বৈঠক করা হয়েছে। তার পরই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। এখন এসব প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যাতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই সঙ্গে আগামীতে যেন কোনো প্রকল্পে একই ধরনের ত্রুটি না থাকে। তবে মন্ত্রণালয়গুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এর মধ্যে আইএমইডির সুপারিশ অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানাতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকার মিরপুরে ৯নং সেকশনে ১৫টি ১৪ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে নানা অনিয়ম হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় আইন মেনে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এমনকি অনুমোদিত ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বাইরেও কাজ করা হয়েছে।

প্রকল্পটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে ৯৩৬ কোটি তিন লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় অনুমোদিত অংশগুলোর বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ডিপিপিতে থাকলেও গত অর্থবছরগুলোতে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি।

কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় ১৫টি ১৪ তলাবিশিষ্ট ভবনে সর্বমোট এক হাজার ৫৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণকাজ চলছে। তবে কোনো ভবনের কাজ পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি গড়ে ৫৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের মে পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ৪২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ যা সন্তোষজনক নয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-ডিপিপিতে সংযুক্ত ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। এ ছাড়া পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্র অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যত্যয় ঘটেছে। যেখানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ (সরকারি ক্রয় বিধিমালা)-এর ব্যত্যয় করা হয়েছে।

পণ্য ক্রয়ের ছয়টি প্যাকেজের মধ্যে মাত্র একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এবং অন্য একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান ছাড়া চারটি কম্পিউটার ক্রয় করা হয়েছে। জিডি-০২ প্যাকেজের আওতায় দুটি মোটরসাইকেল এবং একটি জিপ গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। কার্যক্রমের ২০টি প্যাকেজের মধ্যে ১১টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

কিন্তু প্যাকেজ নং ডব্লিউডি-৩ থেকে ডব্লিউ-১১ পর্যন্ত ৯টি প্যাকেজ ডিপিপি অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এক্ষেত্রে প্যাকেজ নম্বর পরিবর্তন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যেখানে ডিপিপির ব্যত্যয় হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ডিপিপি এবং পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মিত পিআইসি ও পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

সরেজমিন গিয়ে ১১.১৬, ১৭, ১৮ ও ২৪নং ভবনে ব্যবহৃত ইটের মান সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি। চলমান কাজে একেক ভবনে একেক ধরনের রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন ভবন নং-১৭-তে হাই-টিস রেইনফোর্সমেন্ট আবার অন্য ভবনে আরেক রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো বাজারের শীর্ষস্থানীয় কোনো রেইনফোর্সমেন্ট নয়। ভবনের ফলস স্ল্যাব ও লিন্টেলের ঢালাই কাজে ব্যবহৃত পাথরগুলো মানসম্মত নয়।

৬৪ জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ (প্রথম পর্যায়ে ২২ জেলা) : ‘৬৪ জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ (প্রথম পর্যায়ে ২২ জেলা) শীর্ষক প্রকল্পেও রয়েছে নানা অনিয়ম। সেই সঙ্গে প্রকল্প তৈরি সঠিকভাবে না হওয়ায় বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি। ৩৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) ২২ জেলায় পূর্ত কাজের প্রতিটি ভবনের অনুকূলে দুটি করে প্যাকেজ থাকলেও বাস্তবে শুধু কুমিল্লা জেলা ছাড়া সব জেলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই দুটি প্যাকেজ একসঙ্গে করে একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যা ডিপিপি এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ১৭’র ব্যত্যয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) যথাযথভাবে প্রণয়ন না হওয়া এবং ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ডিপিপি অনুযায়ী সময়মতো দরপত্র আহ্বান করতে না পারা এবং ডিপিপি আরডিপিপি অনুযায়ী বছরভিত্তিক আর্থিক ও ভৌত কাজের পরিকল্পনা প্রস্তুত না করার কারণে এমনটি হচ্ছে।

প্রকল্পের শুরুতে যথাযথভাবে বেজলাইন সার্ভে, ফিজিবিলিটি স্টাডি করে ডিপিপি আরডিপিপি প্রণয়ন করা হলে এই সমস্যাগুলো আগেই জানা যেত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-নির্মাণকাজ বিএনবিসি এবং অনুমোদিত ড্রইং ডিজাইন অনুযায়ী কাজ চলমান রয়েছে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত মালামালের ল্যাব টেস্ট এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হ্যামার টেস্টের প্রাপ্ত ফলাফলগুলো সন্তোষজনক পাওয়া গেছে।

সরেজমিন রুম, কলাম, বিম বাউন্ডারি ওয়াল ছাড়াও ছাদের রেলিংয়ের পরিমাণ করে ড্রইং অনুযায়ী সঠিক পাওয়া গেছে। তবে কিছু জেলায় (রাজশাহী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ) নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইটের মান (আকৃতিগত ও কোনা ভাঙা) সন্তোষজনক নয়। নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, সিলেটে ঢালাই কাজে যে পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে তা সন্তোষজনক নয়।

সাটারিং সঠিক না হওয়ায় এবং ভাইব্রেটর মেশিন ঠিকমতো ব্যবহার না করায় কিছু ক্ষেত্রে হানিকম্ব (দেওয়ালে ফোকর বা ছোট ছোট গর্ত) দেখা গেছে। শ্রমিকদের হ্যান্ড গ্লাভস, গাম্বুট, হেলমেট ইত্যাদি সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হয়নি। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহে দরজার জন্য ব্যবহৃত কয়েকটি চৌকাঠে চিড়ল ফাটল দেখা গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় (নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ) প্লাস্টার-পরবর্তী দেওয়ালের অনেক জায়গায় সাদা সাদা লোনা ভেসে উঠেছে।

সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ : ‘সকল জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পে দফায় দফায় মেয়াদ বেড়েছে। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬৭ শতাংশ। সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্যয়ও। মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুসারে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০ কোটি ২০ লাখ টাকায়। পুনরায় সংশোধিত ডিপিপিতে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো হলো-ভবনের পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। যেমন নিচতলায় কোনো বাথরুম দেওয়া হয়নি। নিচতলায় মার্কেটের জন্য যে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে তা ভবনের সামনের প্রাচীরের কারণে দোকান ভাড়া দিতে সমস্যা হচ্ছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসের জন্য ভবনের তৃতীয়তলা নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওঠানামার জন্য কোনো লিফট নেই। ভবনের সামনে যানবাহন পার্কিং করার জন্য কোনো জায়গা নেই। যেসব ভবন ভাড়া দেওয়া যায়নি সেসব ভবনের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অনেক ভবনে ইতোমধ্যেই ফাটল দেখা গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোনো কোনো ভবনের স্থাপত্য ও ইমারতের নকশা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বেশির ভাগ ভবনের নির্মাণকালীন নির্মাণসামগ্রীর প্রয়োজনীয় টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ঠিকাদার প্রোগ্রাম অব ওয়ার্কের কোনো নথি পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ভবনের বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টারে ফাটল দেখা দিয়েছে। পানি ও বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা বিদ্যমান। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ধরনের ফিটিংস, ফার্নিচার ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বিকেএসপির প্রমীলা প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নয়ন : নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই খেয়ালখুশি মতো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ‘বিকেএসপির প্রমীলা প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিন ঘুরে পণ্যের গুণগত মান সন্তোষজনক পাওয়া গেছে। আসবাবপত্র ও ব্যায়ামাগারের মেশিন উন্নত মানের ও ভালো ব্র্যান্ডের। তবে নির্মাণ কাজে অনেক ক্ষেত্রে কার্য সম্পাদনের মান তথা সূক্ষ্মতায় ঘাটতি আছে। ফিনিশিংয়ে দুর্বলতা রয়েছে। নির্মাণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে গরমিল লক্ষ করা গেছে।

অর্থাৎ ডিপিপিতে দেওয়া নকশার বাইরে গিয়ে হোস্টেলের দুপাশে সিঁড়িঘরের পাশে দুটি নতুন কক্ষের নকশা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় আবারও সেই নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। সুইমিংপুলের কভার না থাকা, হোস্টেল ও সইমিংপুলের সিঁড়ির অবস্থান ও আকার পরিবর্তন, হোস্টেলের রেলিংয়ের ডিজাইন ও নির্মাণসামগ্রীর মান, ব্যায়ামাগারের ক্যাডিংয়ে লোভারের পরিবর্তে কাচ, গ্রাস গ্যালারি না করা ইত্যাদি কাজে গরমিল লক্ষ করা গেছে।

এ ছাড়া কিছু স্থাপনা নির্দিষ্ট স্থানের পরিবর্তে অন্য স্থানে করা হয়েছে। যেমন গ্যারেজ ও আরসিসি গ্যালারির অবস্থান ও আকার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ এর ক্রয়সংক্রান্ত নীতিগুলোর (অংশ-১) অনুচ্ছেদ ০৭ অনুযায়ী নতুন নকশা দিয়ে কাজে কীভাবে সমন্বয় করা হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে অনুমোদন নেওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে কোনো দলিল পাওয়া যায়নি। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি-২০০৬ এর অনুচ্ছেদ ৭.২ ও ৭.৩ অনুযায়ী বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ : নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিপিআর-২০০৮ অনুসারে ক্রয়পদ্ধতি হিসাবে একটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ থাকার নির্দেশনা থাকলেও ডিপিপিতে একাধিক প্যাকেজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান, চুক্তি স্বাক্ষর, ক্রয়কার্য সম্পাদনের তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার নির্দেশনা থাকলেও ডিপিপি প্রণয়নে তা অনুসরণ করা হয়নি।

প্রকল্পের পণ্য ক্রয় পরিকল্পনা অনুসরণ না করে দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে একটি প্যাকেজকে ১২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়ছে। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত হলেও লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট ক্রয়ের ক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার তারিখ ৩/৯/২০২১ উল্লেখ করা হয়েছে। ডিপিপি অনুসারে পিএসসি ও পিআইসি সভাও করা হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী : এই উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হচ্ছে বারবার প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদল। এজন্য পিডি নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী স্থাপন’ প্রকল্পে বদল হয়েছে ১১ জন পিডি। এখন দায়িত্ব পালন করছেন একজন।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদে ১১ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমানে ১২তম প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করছেন। ১২ জন প্রকল্প পরিচালকের মধ্যে মহাপরিচালক নভোথিয়েটার, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসাবে ৬ বার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পটির স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদে সমাপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী যথাযথভাবে নির্মাণকাজ করছে।

তবে যে সমস্যাটি লক্ষণীয়, তা হলো ভবনের সম্মুখ অংশে সিঁড়িতে রড বাঁধাই করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে ব্যবহৃত রডে রাস্ট পড়ে গেছে। অর্থাৎ ব্যবহৃত উপকরণ, যেমন রড, সাটার ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদে নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায় ব্যবহৃত রডের স্বাভাবিক রাস্ট গ্রহণযোগ্য। দীর্ঘমেয়াদে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলে ব্যবহৃত রডের রাস্ট অপসারণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং বিএনবিসির সঙ্গে বাস্তব কাজের কিছু সাংঘর্ষিকতা রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/440755/